বারান্দায় উঠতেই তিনি
খেয়াল করলেন
ভিতরে অনেক
মানুষের সমাগম।
সম্ভবত কোন
সালিশের কাজ
চলছে। সামনের
সারিতে একই
ডিজাইনের কিছু
চেয়ারের মধ্যে
ভিন্ন ডিজাইনের
এক চেয়ারে
চেয়ারম্যান সাহেব বসা আছেন। চেয়ারম্যান
সাহেব কথা
বলছেন, অন্যরা
তার কথা
শুনছে। এখন
চেয়ারম্যন সাহেবের সাক্ষাৎ সম্ভব
নয়। সাক্ষাৎ পেতে
হলে এই
সভা শেষ
না হওয়া
পর্যন্ত তাকে
অপেক্ষা করতে
হবে। ততক্ষণ
কি দেরী
করবেন? বাম
পাশের যে
রুমে চেয়ারম্যান
বসেন সেখানে
তার মতো
অপেক্ষমান আরো কয়েক জনকে দেখা
গেল। তিনি
সেদিকেই এগিয়ে
গেলেন।
রূপনগর ইউনিয়ন পরিষদ।
চেয়ারম্যানের রুমে বসে থাকা অনেকের
মত তিনিও
চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎ প্রত্যাশী একজন
ব্যক্তি। তিনি
আব্দুল হক।
এই ইউনিয়নের
সোনাপুর গ্রামের
অধিবাসী। দরকার
ছাড়া খুব
একটা এখানে
আসা পড়ে
না।
পাশের রুমে সালিশ
শেষ করে
চেয়ারম্যান সাহেব এই রুমের পিছন
দিক দিয়ে
প্রবেশ করে
আব্দুল হকের
পাশ দিয়ে
সামনের দিকে
এগিয়ে গেলেন।
আব্দুল হক
উঠে দাঁড়িয়ে
মুখের মাঝে
একটা হাসির
রেশ ধরে
রাখার চেষ্টা
করে চেয়ারম্যান
সাহেবকে সালাম
দিলেন। প্রতিউত্তরে
চেয়ারম্যান সাহেবের কোন প্রকার ভাবান্তর
লক্ষ্য করা
গেল না।
শব্দ করে
সালামের উত্তর
না দিলেও
অন্তত মাথা
ঠুকতে পারতেন।
কিন্তু তিনি
সেটাও করেননি।
এমনকি আব্দুল
হকের দিকে
মোটেও না
তাকিয়ে সোজা
গিয়ে চেয়ারে
বসলেন। এমন
আচরণে আব্দুল
হক তেমন
মনোক্ষুণ্ন হননি। তবে তিনি যে
ব্যাপারে চেয়ারম্যানের
কাছে এসেছেন
তার জন্য
পরিবেশ তৈরীর
ক্ষেত্রে এটা
সুবিধাজনক নয়। তারপরও তিনি এটাকে
স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন এই ভেবে যে,
চেয়ারম্যান সাহেবকে এত বড় একটা
ইউনিয়নের কত
ঝামেলা মাথায়
নিয়ে চলতে
হয়। এমন
সামান্য কিছুতে
কী আর
মাইন্ড করলে
চলে! অবশ্য
নির্বাচনের আগে এই চেয়ারম্যান সাহেব
মাদ্রাসার মাঠে কাজে ব্যস্ত থাকা
আব্দুল হককে
সালাম দিয়ে
কুশল জেনেছেন।
এমনকি মুসাওয়া
করার জন্য
তিনি নিজে
মাঠের মধ্যে
হেঁটে গেছেন।
এ কথাটা
আব্দুল হক
ভুলে যাননি।
সেদিন তিনি
মাদ্রাসার নানান খোঁজ খবর নিয়েছিলেন
এবং মাদ্রাসা
ও এতিমখানার
উন্নতির জন্য
কি কি
করা যায়
সে বিষয়ে
কিছু আলোচনাও
করেছিলেন। আরো বলেছিলেন "দোয়া করবেন
ভাই, যেন
পাশ করে
করে এই
প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু অনুদানের ব্যবস্থা
করতে পারি।"
চেয়ারম্যান সাহেব সেই নির্বাচনে পাশ
করার পর
দুই বছর
পার হয়ে
গেলেও তার
সেই প্রতিশ্রুতির
কোন বাস্তবায়ন
আব্দুল হক
দেখতে পাননি।
অবশ্য এর
মধ্যে চেয়ারম্যান
সাহেবকে দুইবার
স্মরণ করিয়ে
দিয়ে মাদ্রাসার
নাজুক অবস্থার
কথা জানিয়েছেন।
শুনে চেয়ারম্যান
সাহেব আশ্বাস
দিয়েছিলেন বটে কিন্তু কবে বাস্তবায়ন
হবে তার
কোন মেয়াদ
দেননি। দীর্ঘদিন
অতিবাহিত হওয়ার
পর তিনি
চেয়ারম্যান সাহেবের দেওয়া আশ্বাসের মেয়াদের
কোন দিগন্ত
খুঁজে না
পেয়ে আজ
আবারও চেয়ারম্যানের
দারস্থ হয়েছেন।
সামনের সারিতে বসে
থাকা সত্তরোর্ধ্ব
বৃদ্ধ লোকটি
তার আসার
উদ্দেশ্য জানালেন
চেয়ারম্যান সাহেবকে। তার সংসারে আয়
উপার্জনক্ষম কেউ নেই এবং তিনি
নিজেও আয়
করতে পারেন
না, বিধায়
এলাকার লোকজনের
কাছে বয়স্ক
ভাতার কথা
শুনে তিনি
ছুটে এসেছেন
চেয়ারম্যানের কাছে। তার কথা শুনে
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন যে, নামের
তালিকা তো
আগেই পাঠানো
হয়ে গেছে,
এখন আর
সম্ভব নয়,
আবার যখন
নতুন তালিকা
তৈরা করা
হবে তখন
তাকে জানানো
হবে। এখন
তাকে চলে
যেতে বললেন।
পরের চেয়ারের
লোকটা জানালেন
তার উদ্দেশ্য,
তাদের এলাকার
মসজিদের পুকুরে
মানুষের ওজু
করার সুবিধার্থে
একটি পাকা
ঘাট তৈরী
করে দেওয়ার
প্রস্তাব দিয়েছেন।
তিনি আরো
জানালেন, ছয়
মাস আগে
মসজিদে আসরের
নামাজ পড়তে
গিয়ে চেয়ারম্যান
সাহেব মসজিদের
ঘাটটা তৈরী
করে দিবেন
বলে এসেছিলেন।
এবার চেয়ারম্যান
সাহেবের উত্তরটাও
অনেকটা একই
ঘরানার। তিনি
বললেন- "আপাতত কোন অনুদান ইউনিয়ন
পরিষদের ফান্ডে
নেই, আপনাদের
কথাটা মাথায়
থাকলো, নতুন
ফান্ড আসলে
দেয়া হবে।"
চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে
অন্যান্যদের কথোপকথন শুনে আব্দুল হক
অনেকটা অনুমান
করে নিয়েছেন
তার কথার
জবাবে চেয়ারম্যান
সাহেব কি
বলবেন। আব্দুল
হক জানেন
ফান্ডে না
থাকলেও চেয়ারম্যানদের
কিছু করার
থাকে। তবে
তার জন্য
দরকার হয়
ইচ্ছাশক্তি। আর সেই ইচ্ছাশক্তি বা
মানসিকতা তৈরী
করা এই
পরিবেশে সম্ভব
নয়। এখন
তার মন-মানসিকতা সেই
ধরনের নয়,
তাছাড়া দাবী
নিয়ে আসা
এতগুলো মানুষের
মধ্যে তার
দাবীটাকেই এভাবে গুরুত্ব দেয়া বেমানান
হয়ে যাবে
সুতরাং তার
উচিত হবে
এখন চেয়ারম্যান
সাহেবকে কিছু
না বলে
একটি নিরিবিলি
পরিবেশের জন্য
অপেক্ষা করা।
একথা ভেবেই
আব্দুল হক
রুম থেকে
বেরিয়ে আসার
সিদ্ধান্ত নিলেন। চেয়ার থেকে উঠে
তিনি সোজা
রাস্তায় নেমে
পড়লেন।
২.
ইউনিয়ন পরিষদের সরু
পথটা শেষ
শেষ করে
বড় রাস্তায়
পা রাখতেই
কানে এল-
“মাওলানা সাহেব
আসসালামু আলাইকুম”। আব্দুল
হক সেদিকে
তাকিয়ে সালামের
উত্তর দিলেন।
তিনি লোকটাকে
চিনেন না।
মুসলমান ভাই
হিসাবেই সালামের
আদান-প্রদান।
আব্দুল হক
মাওলানা না
হলেও বুঝতে
পেরেছেন কথাটা
তাকেই উদ্দেশ্য
করে বলা
হয়েছে। শিক্ষাজীবনে
মাদ্রাসায় না পড়লেও দীর্ঘদিন যাবত
হাফেজী মাদ্রাসা
ও এতিমখানার
সাথে জড়িত
থাকার সুবাদে
তার লেবাসে
সুন্নতী রূপ
চলে আসায়
তিনি মাওলানা
সম্বোধনটা পেয়ে থাকেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির
পরিচালনা কমিটির
সেক্রেটারী। বেশ কয়জন গন্যমান্য ব্যক্তি
কমিটিতে নানা
পদ দখল
করে থাকলেও
প্রায় যাবতীয়
কাজকর্মে সবাই
আব্দুল হকের
উপরই ভরসা
করেন। দিনের
সিংহভাগ সময়
তিনি ব্যয়
করেন এই
প্রতিষ্ঠানটির পেছনে। তার চিন্তা-চেতনায়
নিজের সংসারটা
নিয়ে যতটুকু
ভাবনা না
থাকে তার
চেয়ে বেশি
থাকে মাদ্রাসাটির
জন্য। ভোরবেলা
মাসুম বাচ্চারা
যখন সুর
করে পবিত্র
কোরআন তিলাওয়াত
করে তখন
মনটা ভরে
ওঠে তার,
যেটা অন্য
কিছুতে তিনি
পান না।
ইচ্ছে আছে
বাকী জীবনটাই
এই প্রতিষ্ঠানের
কল্যাণে পরিশ্রম
করে যাবেন।
তার আরেকটা
ইচ্ছে ছিল,
সেটা আল্লাহ
কবুল করেননি।
ইচ্ছে ছিল
তিনি নিজের
ছেলেকে হাফেজ
বানাবেন। আর
সেই ছেলেই
এক সময়
এই প্রতিষ্ঠানে
শিক্ষা দিবে।
সেই ছেলের
মাধ্যমে শত
শত হাফেজ
তৈরী হবে।
কিন্তু সেটা
আর হলো
না। আল্লাহ
তাকে ছেলে
সন্তান তো
দূরের কথা,
কোনো সন্তানই
দেননি। চিকিৎসা-পাতী
অনেক করেছেন
কিন্তু লাভ
হয়নি। সবিশেষ
তিনি সবই
আল্লাহ তায়ালার
ইচ্ছা ভেবেই
মেনে নিয়েছেন।
চলার মাঝে আব্দুল
হঠাৎ
খেয়াল করলেন
তার থেকে
কিছুদূর সামনে
হেটে যাওয়া
মানুষটাকে কেমন যেন চেনা চেনা
লাগছে। ঠিক
মত আন্দাজ
করতে পারছেন
না। লোকটার
ডান হাতে
একটা পলিথিনের
ব্যাগ। লোকটার
চলন-ভঙ্গী
যেন পরিচিতই
মনে হচ্ছে।
তিনি একটু
জোরে হেঁটে
এগিয়ে গেলেন।
কাছাকাছি হতেই
লোকটাকে পুরোপুরি
সনাক্ত করে
ফেললেন। এতো
তাদের এলাকারই
সেই হাবিব
উল্লাহ ওরফে
হাইবুল্লা।
তিনি পেছন থেকে
বললেন, “কেমন
আছো হাইবুল্লা?”
কথাটা শুনে
পেছনে তাকায়
লোকটা। জবাবে
সে 'ভালো
আছি' বললেও
তার কথার
মাঝে যথেষ্ট
বিব্রতকর ভাব
খেয়াল করলেন
আব্দুল হক।
সেই ভাবটা
কাটিয়ে উঠে
কিছুটা স্বাভাবিক
হওয়ায় চেষ্টা
করে। সে
এখন কোথায়
থাকে জানতে
চাইলে বলে,
মধুপুরের এক
মক্তবে সে
সকাল-বিকাল
বাচ্চাদের পড়ায়। ব্যস্ত থাকতে হয়
বলে বাড়ির
দিকে বেশি
আসতে পারেনা।
আব্দুল হক জানেন
বাড়ির দিকে
আসার পরিবেশও
সে রাখেনি।
অপকর্ম করে
লজ্জায় এলাকা
ছাড়তে বাধ্য
হয়েছিল। এলাকার
মসজিদের ওয়াক্তিয়
নামাজের ইমামতি
করতো সে।
মসজিদের ইমামতি
করার সুবাদে
পাশের গ্রামের
কওমী মাদ্রাসার
লিল্লাহ বোডিংয়ের
দান গ্রহণের
রশিদ বই
তার কাছে
দেয়া হয়েছিল।
সে অবসর
সময়ে মানুষের
দান উঠিয়ে
ঐ মাদ্রাসায়
পাঠিয়ে দিত।
হঠাৎ
একদিন শোনা
গেল সে
নাকি মানুষের
কাছ থেকে
টাকা পয়সা
ধান, চাল
উঠিয়ে অর্ধেক
নিজে রাখে
আর বাকী
অর্ধেক মাদ্রাসার
রশিদ বইয়ে
লিখে পাঠিয়ে
দেয়। পরে
এক জুম্মার
দিনে অনেকটা
আনুষ্ঠানিকভাবেই তাকে অপমান করে ওয়াক্তিয়
নামাজের ইমামের
পদ থেকে
বরখাস্ত করা
হয় এবং
আরো জানানো
হয় কোন
প্রকার ধর্মীয়
কর্মকান্ডে তাকে যেন কেউ জড়িত
না রাখে।
আব্দুল হক হাইবুল্লার
মাঝে কেমন
যেন একটা
অস্থিরতা খেয়াল
করলেন। হয়ত
তার সাথে
দেখা হওয়াটা
সে আশা
করেনি। এ
কথার চূড়ান্ত
প্রমাণ পাওয়া
গেল যখন
সে “ব্যস্ত
আছি” বলে
চলে যেতে
চাইল। তার
কথার প্রেক্ষিতে
আব্দুল হক
জানালেন- “ঠিক আছে যাও, সব
সময় ভালো
কাজের সাথে
থাকার চেষ্টা
করবা তাহলে
মানুষেরও সুনাম
পাওয়া যাবে,
আল্লাহ তায়ালার
সন্তুষ্টিও পাওয়া যাবে।” আব্দুল হকের
এই কথায়
অতীতের সেই
ঘটনার সুর
খুঁজে পায়
হাইবুল্লাহ। তাই এখন তার ধারণা
যে অমূলক
তা বুঝাতে
সে জানায়-
মানুষ একবার
ভুল করতেই
পারে। সে
ঐ ধরনের
কাজ আর
করে না।
কেউ রশিদ
বই দিতে
চাইলেও নিতে
রাজি হয়
না। কথাটা
শেষ করেই
চলে যেতে
উদ্যত হয়।
ঠিক তখনই
ঘটে আরেক
বিপত্তি। হাঁটার
গতি বাড়াতে
গিয়ে সামান্য
ঝাঁকুনির সৃষ্টিতে
হাতের পলিথিন
ব্যাগটা ছিড়ে
ভিতরের কিছু
কাগজপত্র মাটিতে
পড়ে যায়।
এই ঘটনায়
হাইবুল্লা যেন হঠাৎ করেই
ঘাবড়ে যায়।
তৎক্ষণাৎ
সে আবদুল
হককে আড়াল
করে ব্যাগের
মধ্যে ওগুলো
ঢুকাতে থাকে।
আড়াল করার
কারণে আব্দুল
হকের মনে
কৌতুহল সৃষ্টি
হয়। একটু
ভালোভাবে নজর
করতেই দেখেন,
ভিন্ন ভিন্ন
নামে কয়েকটি
মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানার রশিদ
বই। হাইবুল্লা
পিছনে ফিরে
আব্দুল হককে
তাকিয়ে থাকতে
দেখে আমতা
আমতা করতে
করতে বলে-
“ভাই, এগুলো
থেকে টাকা
উঠিয়ে সত্যিই
আমি এক
টাকাও রাখি
না। সবটাই
ঐ মসজিদ
ও মাদ্রাসায়
জমা দিয়ে
দেই। তাদের
সাথে আলাপ
করা আছে,
আমি কষ্ট
করে বিভিন্ন
গ্রাম ঘুরে
যা উঠাই
তা থেকে
অর্ধেক তারা
আমাকে দিয়ে
দেয়।” প্রচন্ড
রাগ হচ্ছিল
আব্দুল হকের।
একটা রশিদ
বই হাতে
নিয়ে সেটার
দিকে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে থেকে
বলেন- “আলীপুর
গ্রামে আমি
সব সময়
যাতায়াত করি।
ওখানের সব
এলাকাই আমি
চিনি। ঐ
গ্রামে “আশরাফিয়া
এতিমখানা” নামে কোনো প্রতিষ্ঠান তো
আমি দেখিনি।
তুমি এই
রশিদ বই
পেয়েছ কোথায়?"
প্রশ্নের জবাবে
হাইবুল্লার কাছ থেকে কোন সাড়া
মিললো না।
মাটির দিকে
তাকিয়ে আছে
সে। আব্দুল
হক তার
চোখের দিকে
তাকিয়ে বলেন-
"সত্যি করে বলো- তুমি কি
নিজের ইচ্ছা
মতো নাম
দিয়ে এই
বই তৈরী
করেছ?" এবারও কোন উত্তর মেলেনি।
তিনি বইটা
ছুড়ে মারেন
হাইবুল্লার মুখের উপর। হাইবুল্লা সেটা
কুড়িয়ে নিয়ে
ব্যাগের মধ্যে
ঢুকিয়ে দ্রুত
হাটতে শুরু
করে। আব্দুল
হক তার
চলে যাওয়া
পথের দিকে
তাকিয়ে থাকেন।
ধীরে ধীরে
সে প্রকৃতির
মাঝে মিলিয়ে
যেতে থাকে
কিন্তু আব্দুল
হকের মনে
হাইবুল্লাকে নিয়ে ভাবনা কমে না।
ভাবতে ভাবতে
তিনি পা
বাড়ান বাড়ির
দিকে।
৩.
রান্নাঘরে ব্যস্ত খাদিজা
বেগম। অন্যদিন
আরো আগেই
রান্নার কাজ
শেষ হয়ে
যায়। আজ
বাইরের কাজে
একটু বেশি
সময় ব্যয়
হওয়ায় এখনো
রান্নাঘরে আটকা থাকতে হয়েছে। সংসারের
সমস্ত কাজ
তার একার
হাতেই করতে
হয় বলে
দু'একদিন
রান্না করতে
একটু দেরি
হয় তাতে
অবশ্য স্বামী
আব্দুল হক
কোন প্রকার
অভিযোগ করেন
না। মাঝে
মধ্যে পাশের
বাড়ীর রোমেনা
এসে তাকে
একটু সাহায্য
করে। তবে
খাদিজা বেগম
যথাসম্ভব চেষ্টা
করে রোমেনাকে
কষ্ট না
দেয়ার। স্বামী
দিনের বেশির
ভাগ সময়ই
বাইরে থাকেন
তাই তাকে
বাড়ীতে একাই
থাকতে হয়।
রোমেনা এসে
একটু সঙ্গ
দিলে সেটাই
বড় পাওয়া,
অন্তত একজন
কথা বলার
মানুষ পাওয়া
যায়। তাকে
দিয়ে কাজ
করিয়ে নিলে
পরে আর
না আসতেও
পারে এটা
ভেবে তাকে
কোন কাজে
হাত লাগানোর
তেমন সুযোগ
দেয়া হয়না।
স্বামীর আসার সময়
হয়ে গেছে
ভেবে খাদিজা
একটু তাড়াহুড়া
করে। যদিও
আত্মবিশ্বাস আছে তিনি কিছু বলবেন
না। আশে
পাশের অনেক
বাড়ীতে এই
একই ব্যাপারে
বকাবকি করতে
দেখা যায়।
অথচ সেই
অভ্যাসটা আব্দুল
হকের মধ্যে
নেই দেখে
খাদিজা বেগম
মনে মনে
তাকে সম্মান
করে। তাকে
সম্মান করার
মত অনেক
গুণই ধরা
পড়েছে খাদিজা
বেগমের চোখে।
বছর তিনেক
আগেও এমনটা
ছিল না
তাদের মধ্যে।
তার সন্তান
না হওয়ায়
ভালো কোথাও
গিয়ে চিকিৎসা করানোর
কথা বললেও
তিনি তেমন
গুরুত্ব দেন
না তাই
স্বামীর উপর
একটা চাপা
অভিমান ছিল
তার। মাতৃত্বের
আকাঙ্ক্ষার টানে সব সময় বলত
শহরে গিয়ে
দুজন চিকিৎসা নেয়ার।
কিন্তু সব
সময় আব্দুল
হকের পক্ষ
থেকে হেলালী
বা গড়িমসি
ভাব লক্ষ্য
করেছে। এজন্য
সে ধরেই
নিয়েছিল সমস্যাটা
মনে হয়
স্বামীরই তাই
এমন করে।
একদিন সে
স্বামীকে অনেকটা
জোর করেই
রাজধানীতে নিয়ে চেকআপ করায়। কিন্তু
রিপোর্ট পেয়ে
সে দিশেহারা!
সমস্যাটা আসলে
স্বামীর নয়;
তার নিজের।
তার গর্ভধারণ
ক্ষমতা নষ্ট
হয়ে গেছে।
সে প্রচন্ড
ভেঙে পড়ে।
তাকে সান্ত্বনা
দিতে তার
স্বামী তার
মাথায় হাত
রেখে সেদিন
যে কথাটা
বলেছিলেন তা
সে এখনো
ভোলেনি। সেদিন
তিনি বলেছিলেন-
“খাদিজা মন
খারাপ করো
না, সবই
আল্লাহর ইচ্ছে।
এখন তোমার
হাতে যে
রিপোর্ট দেখছো
এটা তুমি
আজকে দেখলেও
আমি দেখেছি
পাঁচ বছর
আগে। সেবার
খুলনায় গিয়ে
তোমার অজান্তে
চেকআপটা তখন
একবার করা
হয়েছিল। কিন্তু
রিপোর্টটা তোমাকে জানায়নি। জানালে চিন্তাগ্রস্ত
হয়ে পড়বা
এবং নিজেকে
অসহায় ভাববা
এই ভেবে।
আর চিকিৎসার ব্যাপারে
আমার অনিচ্ছা
দেখে যাতে
আমার সমস্যা
ভেবে আমাকে
দায়ী করে
তুমি নিজে
মানসিক ভাবে
ঠিক থাক
এটাই চেয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি
আমাকে আর
এভাবে বেশিদিন
যেতে দিলে
না।” সেদিনের
এই কথার
কারণে খাদিজা
বেগম তার
স্বামীকে শুধু
স্বামীর আসনই
নয় একজন
মহান ব্যক্তির
আসনে অধিষ্ঠিত
করেছে।
বারান্দায় পায়ের শব্দে
খাদিজা বেগম
বুঝতে পারে
তার স্বামী
চলে এসেছে।
সে খাবার
প্রস্তুত করার
জন্য তৎপর হয়।
বাইরে নজর
করে স্বামীর
দিকে তাকিয়ে
হাত মুখ
ধুয়ে বসতে
বলে। আব্দুল
হক পাঞ্জাবী
ছেড়ে গামছা
নিয়ে পুকুরের
দিকে যায়।
পুকুর থেকে
ফিরে আসার
আগেই খাদিজা
বেগম খাবার
নিয়ে হাজির
হয়। আব্দুল
হক খাদিজা
বেগমের ধোঁয়ামাখা
মুখের দিকে
তাকিয়ে বলেন
“তুমিও বস
না এক
সাথে”।
উত্তরে সে
জানায়, রান্নাঘরে
এখনো তার
অনেক কাজ
আছে, সেগুলো
শেষ না
করে এখন
খেতে পারবে
না। এরপর
সে জানতে
চায়, তিনি
যে পরিষদে
গিয়েছিলেন তার খবর কি? আব্দুল
হক বলেন,
“আজ ওটা
হবে মনে
করেছিলাম কিন্তু
হলো না।
এতিমখানার জন্য টাকা ম্যানেজ করা
জরুরী হয়ে
পড়েছে। অবশ্য
আগামী কাল
মাওলানা জাকির
সাহেবের সাথে
একজনের কাছে
যাওয়ার কথা
আছে, ওখানে
একটা ব্যবস্থা
হতে পারে।
হাজী লুৎফর সাহেব।
রহিমপুর গ্রামের
সব চেয়ে
ধনী মানুষ।
দেখি ওখানে
কী হয়।”
খাদিজা বেগম
তরকারির বাটিটা
প্লেটের কাছে
এগিয়ে দিয়ে
রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
৪.
লুৎফর সাহেবের
বাড়িটা অনেক
বড়। মেইন
গেটের কাছে
একটা রুমে
আব্দুল হককে
বসতে দেয়া
হয়েছে। লুৎফর সাহেব
ভিতরের ঘরে
আছেন। তার
আসতে দেরী
হবে ভেবেই
তিনি আগন্তুকের
আসার উদ্দেশ্য
লোক মারফত
জেনে নিয়েছেন।
আব্দুল হক
তার আসার
কারণ সরাসরি
লুৎফর
সাহেবের কাছে
বলার কথা
ভাবলেও পরে
একটু ভেবে
সেই লোকের
কাছে বলেছেন।
আশে-পাশে
অনেক লোক
বিভিন্ন কাজে
ব্যস্ত। বাড়ির
পরিবেশ দেখে
বোঝাই যায়
অনেক ধনী
মানুষ। জাকির
সাহেব ঠিক
লোকেরই সন্ধান
দিয়েছেন। আজ
জাকির সাহেবেরও
আসার কথা
ছিল। কিন্তু
তার আব্বা
হঠাৎ
অসুস্থ হয়ে
পড়ায় আসতে
পারেননি। জাকির
সাহেব সাথে
থাকলে আরো
ভালো হতো।
একটু পরেই লুৎফর সাহেব
প্রবেশ করলেন।
আব্দুল হক
আগে থেকে
উনাকে না
চিনলেও তার
আগমনে কাজের
লোকজনের যে
পরিবর্তন লক্ষ্য
করা গেছে
তাতে সহজেই
বোঝা গেছে
ইনিই তাদের
মনিব লুৎফর সাহেব।
আব্দুল হক
উঠে দাঁড়িয়ে
সালাম দিলেন।
লুৎফর
সাহেব আব্দুল
হকের দিকে
তাকিয়ে বললেন-
“এতিমখানার জন্য আপনিই এসেছেন?” কথাটা
বলার সময়
তার ভাবমূর্তি
যথেষ্ট গম্ভীর
ছিলো সেটা
আব্দুল হক
খেয়াল করেছেন।
এধরনের মানসিকতা
তার উদ্দেশ্য
সফলের জন্য
তেমন সহায়ক
না। তারপরও
এত দূর
থেকে এসে
এত সহজেই
তো আশা
ছেড়ে দেয়া
যায় না,
তিনি নরম
সুরে বলেন-
“জ্বি, আমি
এসেছি”।
এবার আরো
গম্ভীর লুৎফর সাহেব।
“এই টাকা
যায় কোথায়?
নিজেরা উদর
ভর্তি করেন
তাই না?
ব্যবসাটা ভালোই
ধরেছেন আপনারা।
মুখে একটা
সাইনবোর্ড লাগিয়ে কয়েকটা রশিদ বই
বানিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসার নাম
করে দিব্বি
টাকা তুলে
বেড়ান। আপনাদের
ব্যবসাটা ভালোই।”
কথাগুলো শুনে হতবাক
হলেন আব্দুল
হক। যেন
বাকশক্তি হারিয়ে
যাচ্ছে তার।
এ কী
বলছেন লুৎফর সাহেব!
তিনি কোন
কিছু শুনলেন
না, খোঁজ
খবরও নিলেন
না। এভাবে
অপবাদ দিয়ে
অপমান করাটা
ওনার মত
বিজ্ঞ মানুষের
পক্ষে কিভাবে
সম্ভব? লুৎফর সাহেব
গলাটা ঠিক
করে আবারও
বললেন- “শোন
মৌলভী, ক’দিন আগেই
তোমার মত
একজন মানুষ
কতকগুলো ভুয়া
রশিদ বই
নিয়ে টাকা
তুলতে এসে
ধরা খেয়েছে।
লোকজন তারে
ইচ্ছা মত
পিটিয়েছে। যদি ঐ ব্যাটার মত
মাইর খেতে
না চাও
তাহলে ভালোয়
ভালোয় জায়গা
খালি করো।"
লুৎফর সাহেব
এরই মধ্যে
আপনি থেকে
তুমিতে এসে
গেছেন। এমনভাবে
অপমানিত হতে
হবে আব্দুল
হক কোন
সময় কল্পনাও
করেননি। কিন্তু
লুৎফর
সাহেবের বর্ণনা
মতে এমন
মানুষ কে
হতে পারে
যে ইসলামের
সুরতে এমন
অপকর্ম করতে
পারে? ভাবতে
ভাবতেই তার
মনের পর্দার
ভেসে উঠলো
পরিচিত একজনের
ছবি। হ্যাঁ,
ওদের মত
মানুষেরই পক্ষেই
এ কাজ
করা সম্ভব।
মানুষটা হাইবুল্লা।
হাইবুল্লা শুধু তার এলাকাতেই থাকবে
এমন তো
না, সব
এলাকাতেই দু’একজন থাকতে
পারে। এই
মুহুর্তে কোনো
যুক্তি উপস্থাপন
করা উচিত
কিনা কিছুই
বুঝতে পারছেন
আব্দুল হক।
একবার নজর
উঠিয়ে লুৎফর সাহেবের
দিকে তাকিয়ে
দেখেন বড়
বড় চোখে
তাকিয়ে আছেন
তিনি। কথা
বলার চেষ্টা
করলে না
শুনে যদি
উল্টো ক্ষেপে
যায় তবে
পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে ভাবাটা
কঠিন। তারচেয়ে
পশ্চাৎগমনই
শ্রেয়।
মাথা নিচু করে
আস্তে আস্তে
ঘরের বাইরে
বের হয়ে
এসে গেট
অতিক্রম করলেন।
যে মানুষটা
এই অপকর্ম
করতে গিয়ে
ধরা পড়ে
মার খেয়েছে
সে কি
জানে এর
প্রভাব কত
দূর যাবে?
ঐ একজন
মানুষ সমগ্র
এলাকাবাসীদের কাছে আব্দুল হকের মত
এই সুরতের
সকল মানুষ
সম্পর্কে একটা
কু-মনোভাব
তৈরী করে
দিয়েছে। ভারাক্রান্ত
মনে আব্দুল
হক সামনের
দিকে হাটতে
থাকেন।
মনে নানা চিন্তা
ভেসে ভেসে
উঠছে। সেই
ভাবনা একসময়
অন্য দিকে
যেতে থাকে।
সোনালী যুগের
মানুষেরা কতইনা
চিন্তা-ভাবনা
করে কাজ
করতেন। হযরত
বোখারী (র.)
একবার সমুদ্র
পথে সফরে
বের হয়েছিলেন।
যাত্রাপথে এক সঙ্গীর সাথে গল্প
হচ্ছিল তার।
এক পর্যায়ে
তিনি জানালেন-
সফরের প্রয়োজনে
তিনি ছোট্ট
কাপড়ের ব্যাগে
করে এক
হাজার মুদ্রা
রেখেছেন। ঐ
লোকটা ভালো
ছিল না।
সে মুদ্রাগুলো
পাওয়ার লোভে
জাহাজ কর্তৃপক্ষের
কাছে গিয়ে
বোখারী (র.)
এর বর্ণনার
সাথে মিল
করে জানায়
তার এক
হাজার মুদ্রা
চুরি হয়েছে।
তার কথা
মত কর্তৃপক্ষ
সবাইকে তল্লাশি
করতে করতে
এসে বোখারী
(র.) কাছে
এসে তল্লাশি
করেও কিছু
না পেয়ে
চলে যায়।
লোকটা অবাক
হয়ে পরে
এসে জানতে
চায়- “আপনার
কাছেও তো
এক হাজার
মুদ্রা ছিল,
সেটাও তো
পাওয়া গেল
না, ব্যাপারটা
কী!” বোখারী
(র.) বলেন-
“চুরি হওয়া
মুদ্রার বর্ণনার
সাথে আমার
মুদ্রা মিলে
গেলে আমি
চোর সাব্যস্ত
হতাম। আমি
ইসলামের দাওয়াতে
বের হয়ে
যদি চোর
হিসাবে চিহ্নিত
হই তখন
কি মানুষ
আমার কথা
শুনবে? উল্টো
অপমান করবে
এবং পরবর্তী
অনুসারীদেরকেও এই অপবাদের রেশ বয়ে
বেড়াতে হবে।
তাই আমি
শুধু আমার
জন্য নয়,
সমস্ত ইসলাম
প্রচারকদেরকে এই কলঙ্ক থেকে বাঁচানোর
জন্য আমার
ঐ মুদ্রাগুলো
সাগরে ফেলে
দিয়েছি।”
কথাগুলো মনে করে
মনটা আরো
ভারী হয়ে
গেল। হাইবুল্লার
মত মানুষেরা
যদি বোখারী
(র.) এর
মত করে
অনুসারীদের কথা ভাবতো তবে তাকে
আজ অপমানিত
হতে হত
না। রাজ্যের
যত গ্লানি
সব যেন
আব্দুল হকের
মাথার উপর
জমা হয়েছে।
এই গ্লানি
বইতে বড্ড
কষ্ট হচ্ছে
তার।
ধীর কদমে হাটতে
হাটতে অনেকটা
পথ চলে
এলেন তিনি।
হঠাৎ
চোখ আটকে
যায় একটি
গেটের নেমপ্লেটে।
সুন্দর করে
লেখা “সরদার
মঞ্জিল”।
এর নিচে
আবার লেখা
“ইব্রাহিম সরদা”। নামটা দেখে
কেন যেন
আশার আলো
জাগে তার
মনে। দানবীর
হিসেবে বড়
নাম ডাক
ওনার। এলাকার
অনেক প্রতিষ্ঠানেই
ইব্রাহিম সাহেবের
বড় অংশের
দান আছে
এ কথা
আব্দুল হক
অনেকের মুখেই
শুনেছেন। এই
মানুষটার কথা
এতদিন তার
মনেই আসেনি।
ওনার কাছে
গেলে ফিরাবেন
বলে মনে
হয় না।
তবে কি
এগিয়ে গিয়ে
একটু কথা
বলে দেখবেন?
কিন্তু মনটা কেমন
যেন থমকে
যাচ্ছে। এখানেও
সেই ধরনের
কিছু হয়েছে
কিনা কে
জানে! ইব্রাহিম
সাহেবের যে
পরিচিতি তাতে
উনার কাছে
এ ধরনের
ঘটনার খবর
থাকাটা স্বাভাবিক
ব্যাপার। মনটা
এখনও হালকা
হয়নি, এরই
মধ্যে আবারও
রিস্ক নিয়ে
যাওয়াটা কি
ঠিক হবে?
মনে সায়
দিচ্ছে না,
সামনের রাস্তাটা
বেশ ফাঁকা,
সেদিকেই নজর
চলে যাচ্ছে।
ইব্রাহিম সাহেবের
মুখোমুখি হওয়ার
চেয়ে বরং
সামনে ফাঁকা
রাস্তায় হেঁটে
বাড়ি চলে
যাওয়াটা আশঙ্কামুক্ত।
সুতরাং এই
আশঙ্কামুক্ত পথটাই তিনি বেছে নিতে
চান।
# # #
(২০১০ সালে সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত)