বিচার


এক.
দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই শফিকুর খেয়াল করে টিভির সামনের বেঞ্চটা আজ বেশ ফাঁকা। সচরাচর এই জায়গাটা ফাঁকা দেখা যায় না। অবশ্য টিভিটা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে, নইলে ফাঁকা জায়গাটা ফাঁকা থাকার কথা না। রবিউলের এই দোকানের সামনে শফিকুর যতবারই আসে ততবারই অবাক হয়। বছর দুয়েক আগেও যে দোকানটাতে অল্প 'টা মালামাল নিয়ে বসে থাকত, আজ সেই দোকানে একুশ ইঞ্চি কালার টিভি, ডিভিডি প্লেয়ার, ফ্রিজ সবই আছে। দুখানা ক্যারামবোর্ড এলাকার কিশোর-যুবকদেরকে সারাক্ষণ চুম্বকের মত ধরে রাখে। সবসময় এখানে লোকজন থাকলেও আজ অন্যদিনের তুলনায় লোকসংখ্যা একটু যেন কম, তাই সামনের বেঞ্চটাও ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। বেঞ্চটা সবসময় টিভির দর্শকদের দখলে থাকে। রঙিন টিভিতে ছবি দেখার ইচ্ছে মাঝে মধ্যে জাগলেও বসার জায়গা না পাওয়ায় তা আর সম্ভব হয় না। আজ বেশ ফাঁকা। একটু বসলে মন্দ হয় না। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চটার উপর বসে শফিকুর। বসে থাকা গুটিকয়েক মানুষ বার বার টিভির দিকে তাকাচ্ছে। তাদের সাথে সেও অপেক্ষার প্রহর গুনছে। বাড়িতে ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টিভিতে বিটিভির লাগামহীন বিজ্ঞাপন দেখতে আর কতইবা ভালো লাগে! রবিউলের টিভিতে বিজ্ঞাপন ছাড়াই নাটক, সিনেমা দেখা যায়। তাও আবার একুশ ইঞ্চি রঙিন টিভি। আজ একটুখানি না দেখে চলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। বসার পর প্রায় দশ মিনিট পার হয়ে গেল, এখনও টিভি ছাড়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তার মত আরো গোটা তিনেক মুখ টিভির দিকে তৃষিত চোখে কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছে। দর্শক শ্রেনীর মানুষগুলোকে দেখে ওপাশ থেকে একজন বললো-
-'টিভিটা বন্ধ করে রেখেছো কেন? ছাড়লে তো ওরা একটু দেখতে পারে'কথাটা বলার পর আশেপাশের মানুষ 'টার দৃষ্টিভঙ্গি যেন বলে দিলো কথায় তাদের সমর্থন আছে। কথাটা শোনার পর রবিউল দোকানদারের প্রতিউত্তরটা এমন হবে ভাবেনি কেউ। খুব স্বাচ্ছন্দ্যে সে বললো- 'আমার সেই গ্রুপ তো এখন নেই, এখন আছে খুচো পার্টি, সামান্য টাকা বিল করে। এগো টিভি দিকিয়ে কোন লাভ নি, কারেন বিলও ওটপে না।'

কথাটা শুনে অন্যদের এখনো বসে থাকার ইচ্ছে থাকলেও শফিকুরের আর বসার ইচ্ছে নেই। রবিউল এমনভাবে কথাটা না বললেও পারতো। সে 'খুচো পার্টি' বলে বেঞ্চে বসে থাকা মানুষগুলোকে যে ছোট করে দেখার চেষ্টা করেছে তা বুঝতে কষ্ট হয়নি শফিকুরের। তাই আর বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ায় রাস্তার দিকে।

রবিউল দোকানদার 'সেই গ্রুপ' বলতে কাদেরকে বুঝিয়েছে সেটাও অজানা নয়। বখাটে টাইপের কিছু ছেলেরা এখানে এসে সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা মারে। এরা আবার একটা ক্লাবঘরও বানিয়েছে। এই ছেলেদেরকে বিড়ি-সিগারেটের পাশাপাশি গাজার স্বাদও পাইয়ে দিয়েছে রবিউল। তাই যাদের কাছ থেকে টাকা বের করে আনা যায় তাদেরকেই টিভি দেখিয়ে আরো বেশি করে ফায়দা লুটে নেয়ার চেষ্টা করে সে।

এই গ্রুপটাকে শফিকুর বরাবরই এড়িয়ে চলে। এদের সরদার খ্যাত মন্টু নামের ছেলেটার সাথে একটু রেষারেষি আছে তার। বিআরডিবিতে চাকরি করার সুবাদে সে এলাকায় বেশ কিছু লোককে ব্যবসায়িক লোন পাইয়ে দিয়েছে। এই খবর মন্টুর কানে গেলে সেও তার ব্যবসাটা বাড়ানোর জন্য লোন উঠিয়ে দেয়ার জন্য বলে। কিন্তু শফিকুর রাজি হয়নি। সে আগেই শুনেছিল মন্টু আশা গ্রামীন ব্যাংকের লোন নিয়ে নিয়মিত দেয় না, উল্টো কিস্তি নিতে আসা মানুষদের সাথে ঝগড়া করে। সবের উপর ভিত্তি করে মন্টুকে সে লোন দিতে রাজি হয়নি। লোন না দেয়ায় বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিল মন্টু।

হাঁটতে হাঁটতে দোকানটাকে বেশ পেছনে রেখে এসেছে। আজ নিরিবিলি পরিবেশ দেখে একটু রঙিন টিভি দেখার খায়েশ হলেও এখন তা পুরোপুরি উবে গেল। বাড়ির টিভিটা সাদাকালো হলেও তা দেখতে কারো গলগ্রহ হতে হয় না। পেছন দিকে আর তাকানোরও ইচ্ছে নেই তার।

দুই.
রান্নাঘরে ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে রান্না-বাড়ায় ব্যস্ত সেলিনা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললেও রান্নাবাড়ার কাজটা এখনো শেষ করা হয়নি। অবশ্য এটা তার জন্য নতুন কিছু নয়। অন্যের কাজ শেষ করে এসে নিজের বাড়ির কাজ করতে গেলে দেরি তো একটু হবেই। যদিও প্রতিদিনই চেষ্টা করা হয় একটু আগে আসতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠে না। আগে আসতে চাওয়ার এই ইচ্ছেটা নিজের জন্য নয়; ছোট্ট মেয়ে রুনার জন্য। নিজে রান্নাবাড়া হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষুধা সহ্য করতে পারলেও রুনা পারে না। তাই আসতে দেরি হয় বলেই সকালে খাওয়ার পর কিছু না কিছু খাবার রুনার জন্য রেখে দেয়া হয়, যাতে ক্ষুধা লাগলে সে খেতে পারে।

পাঁচ বছরের রুনাকে নিয়েই সেলিনার ছোট্ট সংসার। স্বামীর কথা মনে করে মাঝে মাঝে সেলিনার মনে প্রশ্ন জাগে- জগতের সব পুরুষ মানুষ কি তার মতো? কী করে পারে বউ মেয়েকে ভুলে গিয়ে আরেকটা সংসার পাততে? মানুষটা এমন না করলে তাকে আজ কষ্ট করে সংসার চালাতে হতো না। রহিম মিয়ার পোল্ট্রি ফার্মে কাজ করে যে মজুরি পাওয়া যায় তাতেই সংসার চলে। প্রতিদিন একটা দুইটা পর্যন্ত সেখানে কাজ করে তারপর বাড়িতে এসে রান্নাবাড়া করতে হয়। তাই এই দেরিতে সেলিনা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কাজ বেশি থাকলে সন্ধ্যাও লেগে যায়। সেদিন খাওয়া-দাওয়া, গোসল করা কোনটাই নির্দিষ্ট সময়ে আবদ্ধ থাকে না। তিন বছর ধরে সংসারটা তার কাঁধের উপর। কষ্ট করে হলেও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার অনেকেই বলেছে এই বয়সে এভাবে থাকাটা ঠিক না। তুমি আরেকটা বিয়ে-টিয়ে কর। রূপে-গুণে বেশ নজরে পড়ার মত হওয়ায় দুইবার প্রস্তাবও এসেছিল। তবে রুনাকে সাথে নিতে রাজী না হওয়ায় সেই আলোচনার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। রুনাকে মানুষ করার দায়িত্ব নেয়ার মত কোনো আত্মীয়ও তার নেই। তাই নিজের জীবন-যৌবনে প্রফুল্লতা আনতে মেয়েটাকে গন্তব্যহীনে ভাসিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হয়নি সেলিনার কাছে।

এই বয়সে একা থাকা যে নিরাপদ নয় তা কিছুটা হলেও সে বুঝেছে। কিছু কিছু নিশাচর তার নজরে পড়ার চেষ্টা করে। অনেক পরিচিত মুখও আছে তার মধ্যে। সেলিনা কোনো সময়ই তাদের প্রশ্রয় দেয়নি। নিশাচররা তাকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে চেয়েছে তবু সে সম্মত হয়নি। মাঝে মাঝে জীবনটা যখন অতিষ্ঠ লাগে তখন মনে হয় নিশাচরের আহবানে সাড়া দিতে। কিন্তু বিবেকের কাছে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠে না। বার বার বিমুখ করেছে সেই সব নিশাচরকে।

কড়াইতে তরকারি নাড়তে নাড়তে সেলিনা অনুভব করে কেউ যেন পেছন দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে ঘুরে দেখে সখিনা ভাবীর মায়াবী মুখ। সে কাছে এসে বলে- 'ধোঁয়া উড়তে দেখে বুঝলাম তুই কাজের থেকে ফিরে আইছিস, তাই ভাবলাম এট্টু কথা বলে যাই।' সেলিনা একটা পিঁড়ি এগিয়ে দেয় তার দিকে। এই ভাবির সাথে আগে বেশ সময় কাটলেও এখন আর তেমন সময়-সুযোগ হয় না। ভাবী পিঁড়িটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে- 'তুই তো রহিম মিয়ার মুরগীর খামারে কাজ করতি করতি সব কিছু শিখে ফেলিছিস। এখন এক কাজ করলি তো পারিস। কোনো সমিতি থেকে কিছু টাকা লোন নিয়ে আর তোর কাছে যদি কিছু থাকে তা দিয়ে তোর বাড়িতি ছোটখাট একটা খামার করতি পারিস। তালি আর অন্য লোকের খামারে গিয়ে কাজ করতি হবে না, নিজের সংসারটাও ঠিকমত দেকাশুনো করতি পারবি।' ভাবীর কথাটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে সেলিনা। কথাটা তো মন্দ নয়। তাছাড়া রহিম মিয়ার ওখানে ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাওয়া নিষেধ আছে। তাই রুনাকেও একা একা বাড়িতে রেখে যেতে হয়। বাড়িতে ছোটখাট একটা খামার করতে পারলে ভালোই হয়।

বিষয়টা নিয়ে আরো কথা হয় ভাবীর সাথে। একসময় সে চলে যেতে উদ্যত হলে সেলিনা ভাত খেয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করে। সে খেয়ে এসেছে জানিয়ে বিদায় নেয়। বিষয়টা নিয়ে সেলিনার চিন্তার বিস্তৃতি হতে থাকে। ভাবির পরামর্শ মতই কাজ করতে হবে। এলাকায় বেশ কটা সমিতি আছে। এগুলোর মধ্যে শফিকুর যে অফিসে চাকুরী করে সেটাই শুধু মাসিক কিস্তি, আর অন্যগুলো সাপ্তাহিক। ওখান থেকে নিলেই মনে হয় ভালো হবে তাহলে আর প্রতি সপ্তাহে টাকা দেয়ার টেনশন থাকবে না। রান্নার কাজ শেষ করে সেলিনা বাইরে এসে দাঁড়ায়। ল্ট্রির ঘরটা কোন পাশে করা যায় সেটা ভেবে আশেপাশে চোখ বুলাতে থাকে। রান্নাঘরের দক্ষিণ পাশটায় হলে মন্দ হয় না। কাছাকাছি পুকুর আছে, পানি নেয়া সহজ হবে। আলো-বাতাসও পাওয়া যাবে। জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ওখানে তাকিয়ে সেলিনা যেন কল্পনাতেই দেখতে পায়- তার মুরগীগুলো ছোট্ট ছোট্ট শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর খাবার খাচ্ছে।

তিন.
জোছনার আলো থাকলেও গাছগাছালির ছায়া পড়ে পরিবেশটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। মন্টু আর নেদুর হাতের সিগারেটের জ্বলন্ত মুখটা যেন জোনাকির আলোর মতই মনে হচ্ছে। রবিউলের দোকান থেকে দুই প্যাকেট সিগারেট নেয়া হয়েছে। ক্লাবঘরের তাসের আড্ডা সিগারেট ছাড়া ভাবাই যায় না। এক প্যাকেট সিগারেট ছাই হবে জন্মগতভাবে পাওয়া তামাকেই আর অন্য প্যাকেটের সিগারেটের পেটের ভেতর থেকে তামাক বের করে গাজার উপাদান ঢুকানো হবে। হাঁটতে হাঁটতে হঠা থমকে দাঁড়ায় নেদু। অদূরে গাছের নিচে তার নজর আটকে যায়। নেদুর সাথে অন্যান্য সঙ্গী মন্টু, নেছার আর বাসেতও তাকায়। কোনো গাছের ছায়া নয়। দুইজন মানুষের ছায়া। মন্টু অন্যদের ইশারা করে এগিয়ে যায় ছায়া দুটির দিকে। ছায়া দুটি কথাও বলছে। মন্টুরা আরো এগিয়ে যায়। আস্তে আস্তে ছায়া দুটির সামনে এসে দাঁড়ায় তারা। ছায়া দুটি বাক্হীন। নেদু হাতের টর্চলাইট মারে ছায়া দুটির ৎসের দিকে। চেনা দুটি  ‍মুখ। একজনের প্রতি মন্টুর আগে থেকেই বেশ রাগ ছিল। আর অপর মানুষটার প্রতি ছিল আকাঙক্ষা। কতবার কত কিছুর বিনিময়ে তাকে আহবান করা হয়েছিল কিন্তু সে সম্মত হয়নি। তাদের একজনের নাম শফিকুর, অপরজন সেলিনা। মন্টু নেদুর হাত থেকে লাইট নিয়ে শফিকুরের চোখে মেরে বলে- 'ব্যাটা এখানে ফষ্টিনষ্টি করো!' কথাটা শেষ করেই তার কলার চেপে ধরে। শফিকুর হতভম্ভের মত তাকায় মন্টুর দিকে। নেদুসহ বাকি দুজন সেলিনাকে ঘিরে রাখে। কলারটা আরো শক্ত করে ধরে মন্টু বলে- 'অনেক দিন ধরেই তোমারে বাগে পাইনে, ক্লাবে চলো মজা টের পাবা'

কলার ধরে রাখা মন্টুর হাতটার দিকে একবার তাকিয়ে শফিকুর বলে- 'মুখ সামলে কথা বল মন্টু। কিসের ফষ্টিনষ্টি? আমি তো সেলিনা আপারে লোন দেয়ার ব্যাপারে কতা বলতিছিলাম। সেই রকম কিচ্ছু করার ইচ্চা থাকলি আমি তার বাড়িতি যাতি পারতাম। তাছাড়া এখানে তোগো আসতি দেখে আমি তো পালাতিও পারতাম।'

'চালাকি করে লাভ হবে না মিয়া। আমি লোন পাইনে আর এই মাইয়ে লোক সহজেই তোমার কাছে লোন পায়। তোমার ফষ্টিনষ্টি সবাই দেখতি পাবে। ক্লাবে চলো।' কথাটা শেষ করেই কলারটা টান দিয়ে ক্লাবঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। নেদু খপ করে সেলিনার হাতটা ধরে। অসহায়ের মত চেয়ে থাকে সেলিনা। তারপর মন্টুর অনুসারী হয় নেদু। বাছেত ক্লাবঘরের তালা খুলে দেয়। একের পর এক ঢুকে পড়ে সবাই। মন্টুর নির্দেশে দুজনকেই পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা হলো। মন্টুসহ চারজনের চোখে খুশির ছটা ফুটে ওঠে। প্যাকেট খুলে সিগারেট ধরিয়ে স্বস্তির টান দিতে শুরু করে।

ছেলেগুলোর প্রতি শফিকুরের প্রচন্ড রাগ হলেও কিছু বলতে পারছে না। সেলিনাও অসহায়ের মত করে মন্টুর দিকে তাকাচ্ছে। মন্টু তৃপ্তি করে গাল ভর্তি করে ধোঁয়া ছাড়ে।

রাত গভীর হতে থাকে। নিশ্চুপ নিভৃত পল্লী। সুনশান নীরবতা। ঘুমে বিভোর সবাই, শুধু ঘুম নেই ক্লাবঘরের ছয়টা মানুষের চোখে। সেলিনা কাতর চোখে মন্টুর দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে- 'আমার বাচ্চার দোহাই দিয়ে বলতিছি আমরা কোনো খারাপ কাজ করতি চাইনি, আমি লোন নেবার জন্যি শফিকুর ভাইয়ের সাতে কতা বলতিছিলাম। তোমরা আমগোরে ছেড়ে দেও। আমার মাইয়েডা ঘুম থেকে জেগে আমারে না পেয়ে কানতি থাকপেনে। তুমি সবার সাথে এই রকমভাবে বললি সবাই বিশ্বাস করে আমারে খারাপ ভাববেনে। তখন আর কারো সামনে মুখ দেখাতি পারবো না। তোমার পায়ে পড়ি তুমি এইভাবে ভুল বুঝে আমাগো আটকাইয়ে রেখো না।'

মন্টু তাকিয়ে থাকে সেলিনার মুখের দিকে। কোনো কথা বলে না। তারপর চোখ ফিরিয়ে শফিকুরের দিকে তাকায়। শফিকুর নরম সুরে বলে- 'তোর লোনের ব্যবস্থা আমি করে দেব, তবু তুই মানষির সামনে আমাগো ভুল বুঝাসনে' মন্টু এবারও কিছু বলে না, একটু মুচকি হাসি দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।

সেলিনার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মন্টু। চোখ নামিয়ে কোনো কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে অন্যদেরও বেরিয়ে আসার জন্য ইশারা করে। তারাও বেরিয়ে আসে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল ওরা বাইরে আছে। ঘরের মধ্যে শুধু শফিকুর আর সেলিনা। সেলিনা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় শফিকুরের দিকে। শফিকুর চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়।

চার.
ক্লাবঘরের দরজা দিয়ে ঢোকে মন্টু। তার পিছে পিছে অন্যরাও ঢোকে। আস্তে আস্তে মন্টু সেলিনার দিকে যায়। সেলিনার চোখে-মুখে কৌতুহলের ছাপ। মন্টু আরো কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে- 'সকালবেলা মেম্বরকে ডেকে বিচার বসানো হবে। মেম্বর সাহেব এই ক্লাবের সভাপতি। আর আমরা এর সদস্য। আমাদের দাবি যেদিকে যাবে মেম্বরের বিচারের রায় সেদিকে যাবে। আমরা যেখানে হাতে-নাতে ধরিছি তাই আমরা চাব না এই রকম খারাপ চরিত্রের মাইয়ে মানুষ আমাগো গ্রামে থাকুক। তাই ধরে নিতি পারো এই গ্রামে তোমার আর থাকা হবে না'কথাগুলো শুনে সেলিনা যেন আকাশ থেকে পড়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মন্টুর দিকে। সত্যিই যদি বিচার বসানো হয় তবে তো খুব বিপদ হবে। গ্রামের মানুষের সামনে কী করে মুখ দেখাবে? আর গ্রামছাড়া করলে ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে যাবেই বা কোথায়? সেলিনার চোখ ছল ছল করতে থাকে। মন্টু আবারও বলতে শুরু করে- 'তবে তুমি যদি একটা কাজ করো তবে আর তোমাগো এই ব্যাপারটা সকাল পর্যন্ত যাতি দেব না। মেম্বরকেও ডাকপো না আর গ্রামের লোকও কেউ কিছু জানতি পারবে না। কাজটা কঠিন কিছু না, আমারে পারছোনাল এট্টু সঙ্গ দিতি হবে। এর আগে যেটা তোমার কাছে আমি চাইয়েও পাইনি।'

সেলিনা বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে মন্টুর দিকে। সে এমন একটা কথা বলবে তা কল্পনাও করেনি সেলিনা। চুপচাপ থাকে বেশ কিছুক্ষণ। সেলিনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মন্টু। কোন জবাব আসে না। মন্টু আবারো বলে- 'আমি জোর-জুলুম করে তোমার উপর কিছু করবো না। তুমি ভাবনা-চিন্তা করে দেখো কি করবা। সকালবেলা বিচারে বসে সারা গ্রামের মানষির সামনে অপমানিত হয়ে গ্রাম ছাড়তি পারো অথবা রাত্রির মধ্যি ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতি পারো। বলো, কোনটা চাও?' সেলিনা তখনো চুপচাপ। মন্টু জবাবের আশায় চেয়ে থাকে, কিন্তু কোনো জবাব আসে না। এবার সে কিছুটা গম্ভীরভাবেই বলে- 'তবে কি তুমি চাও সকালে সবার সামনে বিচার হোক?' সেলিনা ডানে-বামে মাথা নাড়ে। 'তাইলে যা বলিছি তাতে রাজি?' সেলিনা চুপ থাকে। মন্টু আবারো বলে- 'বলো, রাজি?' সেলিনা আস্তে করে উপর-নীচে মাথা নাড়ে।

মন্টুর চোখেমুখে খুশির রেশ ভেসে ওঠে। অন্যদের ইশারা করে, তারা শফিকুরের বাঁধন খুলে দিয়ে বাইরে নিয়ে বারান্দার খুঁটির সাথে বাঁধে। তারপর একটা কাপড় দিয়ে তার মুখটা বেঁধে দেয়।

মন্টু সেলিনার হাতের বাঁধন খোলে। বাম হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সুইচ বন্ধ করে। মাকড়শার জালের মধ্য থেকে উঁকি মারা বাল্বটার দৃষ্টিশক্তি নিভে যায়। কয়েক সেকেন্ড আগের আলোকিত ঘর এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। মন্টুর লিকলিকে শরীরটা এখন সেলিনার খুব কাছে। মাদকাসক্ত ছিপছিপে দুর্বল শরীরটাকে ছুড়ে ফেলার মত শক্তি সেলিনার বাহুতে থাকলেও মনেতে নেই। তাই আজ আর নিশাচরকে বিমুখ করার উপায় নেই।

ঘরের কালো অন্ধকার আরো কালো হতে থাকে। এর চেয়েও বেশি কালোর মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় সেলিনা। এই কালোরাতের বিনিময়ে সে অপমান আর বিচারবিহীন সকাল দেখার প্রহর গোনে।