অন্য সকাল (কিশোর উপন্যাস)


কালাম স্যার ক্লাসের মধ্যে প্রবেশ করতে করতে তার পাঞ্জাবীর বাম পাশের পটেকের মধ্যে বাম হাতটা ঢোকালেনতিন থেকে চার সেকেন্ড পর হাতটা বের হয়ে আসলোসাথে আসলো একটা খিলি পানএমন দৃশ্য সপ্তাহে দুএকদিন দেখা যায়যেদিন এমনটা দেখা যায় সেদিন ক্লাসের সময়টা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কিছুটা আনন্দেরবিশেষ করে যারা পেছনের বেঞ্চ অলংকৃত করে থাকে তাদের জন্য সুসংসবাদই বলা যায়কারণ এদিন পড়া না পারার জন্য কোনো শাস্তি পেতে হয় না

স্যার এখন থেকে পরবর্তী সময়টা কীভাবে পার করবেন তা পূর্বের অভিজ্ঞাতার আলোকে সহজেই অনুমান করা যায়স্যার এখন সটান হয়ে চেয়ারে বসবেনপা দুটাকে সামনে ছড়িয়ে দিবেন, স্বল্প মেদযুক্ত পেটটাকে কিছুটা সামনে ঝুকিয়ে পেছন দিকে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করে পরম তৃপ্তি নিয়ে পান চিবাবেনতারপর বলবেন ছেলেরা পড়া বলছেলেদের বলা শেষ হলে মেয়েরা বলা শুরু করবিসবাই বলতে শুরু করবে যে পড়া শিখে আসেনি সেও দাঁড়িয়ে হিজিবিজি বলে বসে পড়বে (তার হিজিবিজি শুনে অন্যরা মুখ টিপে হাসবে)তারপর মেয়েরা পড়া বলতে শুরু করবেসবার বলা শেষ হলে কেউ একজন দাঁড়িয়ে বলবে স্যার সবার বলা শেষ হয়েছেতখন স্যার চোখ খুলে ঘড়িটা একবার দেখবেনঘন্টা পড়ার সময় হলে নতুন পড়া দেখিয়ে দিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাবেনআর সময় থাকলে পকেট থেকে নোটবুকটা বের করে চোখ বুলাবেনঅবশ্য সব কিছুর আগে তিনি হাজিরা খাতাটা খুলে মিলিয়ে নিবেন প্রথম ক্লাসে হাজির থাকা সবাই উপস্থিত আছে কি না 

ক্লাসের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পড়া বললেও রাজিবের জন্য ভিন্ন নিয়মসে মুখে না বলে খাতায় লিখে জমা দেয়তার জিহ্বার আড়ষ্ঠ থাকায় কথা বলার সময় মাঝে মাঝে আটকে যায়, অনেকেই এটা দেখে হাসাহাসি করেএ অবস্থা দেখে স্যার তার জন্য খাতায় লিখে জমা দেয়ার প্রথা চালু করেন

কালাম স্যারের নামের সাথে বিশেষ একটা নাম যুক্ত আছেস্কুলের প্রায় সকলেই তাকে টেপা কালাম স্যারনামে সম্বোধন করেতবে দুঃখের বিষয় স্যারের এই নামকরণের ইতিহাস কেউ জানে নাযারা প্রতি বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় তারা উপরের ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে নামের ব্যাপারটা জানতে পারেতারা যখন সপ্তম শ্রেণিতে ওঠে তখন তাদের কাছ থেকে জানতে পারে নতুন আসা ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরাএভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে স্যারের বিশেষ নামটা পৌঁছে যায়কেউ কেউ অবশ্য এর ইতিহাস উঘাটন করার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রক্রিয়া চলতে চলতে এক সময় তারা দশম শ্রেণিতে পৌঁছে যায়তারপর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে স্কুলে থেকে বিদায় নেয়, নামের ইতিহাস আর জানা হয় না, আসে নতুন প্রজন্ম

স্যার কাগজে মোড়া পানটা টেবিলের উপরে রেখে স্যার চেয়ারে বসলেনহাজিরা খাতাটা খুলতে খুলতে চশমার উপর দিয়ে সবাইকে এক নজর দেখে নিলেনতারপর খাতাটা খুলে বললেন,
- রোল নম্বর এক...... দুই......
ছাত্র-ছাত্রীরা উঠে দাঁড়িয়ে প্রেজেন্ট স্যারবলে বসে পড়ছেস্বাভাবিকভাবে রোল কল হতে হতে হঠা বিঘœ ঘটেস্যার রোল নম্বর বত্রিশবলার পর মিশু উঠে দাঁড়িয়ে যেইনা প্রেজেন্ট স্যারবললো অমনি স্যার কী মনে করে যেন তার দিকে তাকালেনস্যারের তাকানো দেখে মিশুও ঘাবড়ে যায়স্যার কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললেন,
- তোমার রোল কত?
মিশু থতমত খেয়ে বলে,
- বাইশ
স্যার মিশুর রোল নম্বর জানতেনবত্রিশে হাজিরা দেয়ায় তিনি বুঝলেন নিশ্চয় কোনো ঘাপলা আছেতিনি খাতার দিকে তাকালেনতারপর বললেন,
- শাকিল কই?
ছাত্ররা কেউ কোনো কথা বলে নাবত্রিশ রোল শাকিলেরসে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যাওয়ার সময় মিশুকে বলে যায় সে যেন কালাম স্যারের ক্লাসে তার হয়ে হাজিরা দিয়ে দেয়অবস্থা দেখে স্যারের মুড আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকেকোনো রকমে রোল কল শেষ করলেন

কালাম স্যারের একটা বৈশিষ্ট্যের সাথে স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রীরাই পরিচিততিনি যেদিন মনে করেন আজ কারো পড়া ধরা নিয়ে কঠোর হবেন না, সেদিন কারো পড়া না হলেও কাউকে কিছু বলেন না, আর যেদিন তিনি ক্ষেপে যান সেদিন তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপারআজ নিজেদের দোষের কারণেই স্যারের কঠোরতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে

রাসেল রাগান্বিতভাবে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকেআজ সে পড়া শিখে আসেনি, স্যারের পান খাওয়ার প্রস্তুতি দেখে আশার আলো দেখেছিল কিন্তু মিশুর এই কাজের কারণে সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছেআজ পিটুনি থেকে রেহাই নেই

স্যার হাজিরা খাতা বন্ধ করে এক পাশে রেখে বললেন,
- যে যে পড়া করে আসোনি উঠে দাঁড়াও
ছাত্র-ছাত্রীরা জানে ক্লাসের পড়া না হলে আগে থেকে উঠে না দাঁড়ালে পরে দ্বিগুণ শাস্তি, তাই যারা পড়া শিখে আসে না তারা স্যারের বলার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ায়এ ক্ষেত্রে পেছনের বেঞ্চের সদস্যরাই তুলনামূলক এগিয়ে থাকেআর এর মধ্যে শাকিলের নামটা খুব কম দিনই বাদ পড়ে

স্যারের মুড বেশ গম্ভীরতিনি টেবিলের উপর রাখা পানের খিলিটা হাতে নিয়ে পকেটের মধ্যে রাখলেনএটা দেখে ছাত্রদের বুঝতে বাকী নেই যে আজ পড়া ফাঁকি দেয়ার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছে



টিফিনের পর অষ্টম শ্রেণিতে নজরুল স্যারের সমাজ বিষয়খুব হাসিখুশি একটা মানুষনজরুল স্যারের ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীরা যে পরিমাণ মজা করতে পারে অন্য কোনো স্যারের ক্লাসে পারে নাছাত্র-ছাত্রীদের সাথে স্যারের যেন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কমাঝে মাঝে স্যার ছাত্রদের সাথে খেলাধুলাও করেনক্লাস টেনের ছাত্ররা মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে ইয়ার্কি করতেও ছাড়ে না

স্যার কাউকে বেত্রাঘাত করেন নাকারো উপর রেগে গেলে মৌখিক শাস্তি প্রয়োগ করেনরাগের মাত্রা যদি কম হয় তাহলে গর্ধবআর যদি একটু বেশি হয় তাহলে জানোয়ারনামক বিশেষণে বিশেষায়িত করেনঅবশ্য স্যারের আরেকটি শাস্তি আছে আরেকটু কঠিনকানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকাঅপরাধের মাত্রা বেশি হলেই  তখন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেনএ ক্ষেত্রে অপরাধী মেয়ে হলে ছেলেদের বেঞ্চের দিকে ফিরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, আর ছেলে হলে মেয়েদের বেঞ্চের দিকে ফিরে থাকবেঅনেকের কাছে এই শাস্তিটা কষ্টের মনে না হলেও কিছু ছাত্র-ছাত্রী মনে করে নজরুল স্যারের এই শাস্তিটা বেত্রাঘাতের চেয়ে অধিক কষ্টদায়ক
স্যার যখন নতুন পড়া বুঝিয়ে দেন তখন সবাই খুব মনযোগ দিয়ে শোনে, স্যার খুব সুন্দর করে বোঝাতে পারেনএ কারণে অনেকেই বলে নজরুল স্যারের ক্লাসের সময় দ্রুত চলে যায়
সময় শেষের দিকেস্যার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
- এরপর তোমাদের কোন স্যারের ক্লাস?
রাসেল উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
- টেপা কালাম স্যারের
কথাটা বলেই সে আতকে ওঠেসহপাঠীদের সাথে এভাবে বলতে বলতে স্যারের কাছেও সেই নামটা বলে ফেলেছেসে সাথে সাথে স্যারের মুখের দিকে তাকায় স্যার ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন কি না তা বোঝার জন্যস্যার তার দিকেই তাকিয়ে ছিলতিনি একটু গম্ভীরভাবে বললেন,
- কোন স্যারের?
- কালাম স্যারের
- সাথে আরেকটা কি যেন বললে?
- কই স্যার, শুধু কালাম স্যার বলেছি
স্যার পেছনে ঘুরে সবার মাঝে একবার চোখ বুলালেনতারপর লিমনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
- এ্যাই, সত্যি করে বল, রাসেল কি বলেছে? নইলে তোকেও শাস্তি পেতে হবে
লিমন উঠে দাঁড়িয়ে তোনামনা করতে করতে করতে বলে,
- বলেছে টেপা কালাম স্যার
স্যার আরো গম্ভীর হয়ে গেলেনতিনি সচরাচর রাগেন না, কিন্তু স্যারদেরকে এমন বলায় হয়তো তিনি রাগ না করে পারলেন নাস্যারের ভাবমুর্তি দেখে অন্যরাও বুঝতে পারে স্যার তার উচ্চ স্তরের শাস্তির রায় দিতে পারেনস্যার রাসেলের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন,
- কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক
রাসেল নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে কান ধরেস্যার তাকে মেয়েদের দিকে তাকাতে বলার আগেই সে সেদিকে তাকায়দেরী করলে দ্বিতীয় বারের মত আরেকটা ধমক খেতে হবেস্যার কিছুক্ষণ গুরুগম্ভীরভাবে বইয়ের পাতা উল্টালেনকিছু একটা ভাবলেনতারপর বললেন,
- বস, আজকের মত মাফ করে দিলাম
রাসেল বসে পড়ে
- কেন মাফ পেয়েছিস জানিস?
- জানি
স্যার অবাক হন রাসেলের কথায়
- বলতো কি জন্য মাফ পেয়েছিস?
- গতকাল নবম শ্রেণির সাথে ক্রিকেট খেলায় আমি ৫২ রান করেছিলাম এ জন্য
স্যার কিছুটা অবাক হলেন
- কীভাবে বুঝলি?
- এর আগের গুলোর জন্য একবার করে ক্ষমা পেয়েছি, এটা বাকী ছিল
রাসেলের কথা শুনে ক্লাসের প্রায় সবাই হেসে ওঠেসকলেই জানে নজরুল স্যার খেলাধুলা খুব ভালোবাসেখেলায় কেউ ভালো করলে স্যার তার পিঠ চাপড়ে উসাহ দেনমাঝে মাঝে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুরস্কৃতও করেনস্যার মনে করেন সবাই পড়ালেখায় ভালো করতে নাও পারে, অন্য বিষয়েও এগিয়ে থাকতে পারেকেউ ক্রীড়া, কেউ শিল্প-সংস্কৃতিতেও ভালো করতে পারেসে কারণেই স্যার এসব ক্ষেত্রে পারদর্শীতার জন্য অপরাধের দন্ডমাত্রা শিথিল করেন
রাসেলের কথা শুনে অন্যদের সাথে সাথে স্যারের মুখটাও হাসি হাসি হলোবললেন,
- আজকের মত মাফ করা হলেও সাবধান, স্যারদের নিয়ে এমনটা করা গুরুতর অপরাধভবিষ্যতে আর এমন বলতে শুনলে তখন ১০০ রানেও মাফ হবে না
নজরুল স্যার কোনো এক সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন স্কুলের মধ্যে তিনি এই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদেরকেই বেশি পছন্দ করেনকারণ তিনি খেয়াল করেছেন এই ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা প্রায় সব দিক দিয়েই পারদর্শীপড়াশুনা, খেলাধুলা কিংবা সংস্কৃতি কোনোটাতেই এই ক্লাসের সাথে অন্য ক্লাস পারে নাসাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এদের গুণের পাল্লাই ভারী থাকেক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলাতেও বেশির ভাগ ম্যাচ এই ক্লাসের দখলে থেকেছেআজ আবারও স্যারের অভিব্যক্তিতে তা উঠে আসেতিনি বললেন,
- তোমাদের ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলেই,......প্রায় সকলেই খুব চৌকসদোয়া করি তোমরা আরো এগিয়ে যাও
স্যারের কথাটা শেষ না হতেই ঘন্টা বাজার শব্দ শোনা যায়তিনি হাজিরা খাতাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেনতারপর ধীর পায়ে বের হয়ে গেলেনপেছনে মেয়েরাও স্যারকে অনুসরণ করে বেরিয়ে পড়ে কমন রুমের উদ্দেশে

স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতেই লিমন রাসেলের উদ্দেশ্যে বলে,
- স্যার প্রায়কথাটা ব্যবহার করেছেন কেন জানিস?
- কিসের প্রায়’?
- ঐ যে বললো না প্রায় সকলেই খুব চৌকস?
- জানি না, কেন বলেছেন?
- খোড়াটার জন্য, ও থাকার কারণেই স্যার প্রায় শব্দটা ব্যবহার করেছেনও আমাদের ক্লাসে না থাকলেই ভালো হতো
কথাটা শাহীনকে ইঙ্গিত করেই বলাসে বসে বসে একটা বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিললিমনের কথাটা তার কানে যায়সে কিছু না বলে চুপচাপ শুনতে থাকেতার পায়ে সমস্যা আছেস্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে নাছোটবেলায় বারান্দার উপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে বাম পায়ে প্রচন্ড চোট পেয়েছিলসে সময় সে ভালোভাবে হাঁটতেও শেখেনি, ফলে তখন সমস্যাটা ভালোভাবে আঁচ করা যায়নিপরবর্তীতে হাঁটতে শিখলে বোঝা যায় তার চলন ভঙ্গী একটু অস্বাভাবাবিকবাম পাটা কিছুটা টেনে টেনে ফেলতে হয়বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমস্যাটা আরো স্পষ্ট হয়এখন তাকে অনেকেই খোড়া শাহীনবলে সম্বোধন করেশুনতে খারাপ লাগলেও সে এটা তার নিয়তি ভেবে মেনে নেয়ার চেষ্টা করে এসেছেআজ লিমনের কথাটা কানে আসতেই সে নতুন রকমের একটা ধাক্কা খায়

রাসেল একবার তাকায় শাহীনের দিকেলিমনও তাকায়কণ্ঠস্বর কিছুটা আস্তে করে বলে,
- শাহীন আমাদের ক্লাসে না থাকলেই ভালো হতোএই খোড়াটার জন্য আমরা কিছুটা অসম্পূর্ণও অনেক কিছুই করতে পারে নাচিন্তা করে দেখ স্যার ওর জন্য আমাদের সবাইকে ভালো বলতে গিয়েও আবার ওর কারণে স্যারকে প্রায়শব্দটা বলতে হলোও না থাকলে তো এমনটা শুনতে হতো না

শাহীন যেন কিছুটা স্তব্ধ হয়ে যায় কথাটা শুনেতার মনটা আরো খারাপ হতে থাকেবইটা বন্ধ করে বাইরে বের হয়ওখানে থাকলে হয়তো আরো কথা কানে আসবে, তাতে কষ্টটা বাড়বেবারান্দার কিনারে গিয়ে দাঁড়ায় সেলিমনের কথাটা যেন কানের কাছে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছেছোটকাল থেকে অনেক অবজ্ঞা সহ্য করতে হয়েছে তাকেসবার কাছ থেকে স্বাভাবিক আচারণ পায়নিসে কারণে তার বন্ধুবান্ধবও কমসব সময় আলাদা থাকার চেষ্টা করেছে, যেন কেউ তাচ্ছিল্য না করেআজ সে জানলো তার উপস্থিতিও কারো কারো জন্য অখুশিরচোখের কোণটা ছল ছল করছেখোলা আকাশের দিকে তাকায় সেকেন তাকিয়ে আছে সে নিজেও জানে নাহয়তো দুঃখ ভোলার চেষ্টা, নয়তা বিধাতাকে কিছু বলার ইচ্ছে 



বিকালে স্কুলের মাঠে হাজিরা না দিলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না লিমনদেরস্কুল ছুটির পর বাড়ীতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে সুর্যি মামার প্রখরতা কিছু কমে আসলে মন ছুটে আসে খেলার মাঠেমাঠের উত্তর পার্শ্বের বকুলতলাটা যাবতীয় শলাপরামর্শের কেন্দ্রএখানে নানান বিষয় নিয়ে মিটিং বসেমিটিংয়ের বিষয়বস্তুতে বেশির ভাগ সময় স্থান পায় খেলাধুলা নিয়েকোন ক্লাসের সাথে কোন ক্লাসের, কোন পাড়ার সাথে কোন পাড়ার, কি পুরস্কার থাকবে, খেলার নিয়মাবলী সবই ঠিক হয় বকুলতলায়আসন্ন ২৬ শে মার্চ উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি মঞ্চ নাটক করার চিন্তাভাবনা চলছেআজ মূলত খেলার চেয়ে নাটকের বিষয়টি আলোচনায় বেশি গুরুত্ব পাওয়া কথানাটকের বই ম্যানেজ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবেনাটকের ভূতটা মূলত নজরুল স্যারই ঢুকিয়ে দিয়েছেনতিনি বলেছিলেন- তোরা তো সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভালোই অভিনয় করিস, ইচ্ছে করলে তো ২৬ শে মার্চে একটা নাটকও বানাতে পারিসস্বাধীনতার চেতনা নিয়ে মঞ্চ নাটক করলে সবার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হবেস্যারের সেই কথার রেশ ধরেই নাটকের পরিকল্পনা

খেলা শেষ করে মাঠের পাশের পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে বকুলতলায় আসন পাতে রাসেল ও লিমনএকটু পরেই যোগ হয় মারুফ, শাকিল, মিশু ও মানিকরাসেল তার ব্যাগের মধ্য থেকে এক প্যাকেট মুড়ি ও এক প্যাকেট ঝাল চানাচুর বের করে সামনে রাখেদেখে লিমনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়
- এই জিনিস আছে এতক্ষণ বলিসনি তো! খুশির আভা ফুটে ওঠে লিমনের চোখে-মুখে
রাসেল হাসি মুখ করে বলে,
-আগে বললে তো এতক্ষণে সাবাড় হয়ে যেত
বাম পাশ থেকে শাকিল বলে ওঠে,
আমি বুঝতে পেরেছিলাম এমন কিছু একটা হবেযেদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলোচনা হয় সেদিন রাসেলের পক্ষ থেকে কিছু একটার ব্যবস্থা থাকে
লিমন মুড়ির প্যাকেটটা টেনে নিয়ে বলে,
-এটাকে সামনে নিয়ে পেটু শাহকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই
হাসতে হাসতে শাকিলও হাত লাগায় কাজেমিশু উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-তোরা একটু অপেক্ষা কর, আমি এক দৌড়ে পেয়াজ আর কাঁচা মরিচ নিয়ে আসিতাহলে আরো মজা হবে
- তাহলে তো ভালোই হয়বলে লিমন
মিশুদের বাড়ি মাঠের কাছেইসে ছোটে বাড়ির উদ্দেশে

কিছুক্ষণ পর পেয়াজ, কাঁচা মরিচ নিয়ে ফিরে আসে মিশুতার হাতে আরেকটি প্যাকেটরাসেল দেখে বলে,
- ওটাতে কি?
- ঝালের পর মিষ্টির ব্যবস্থারহস্য তৈরির চেষ্টা করে মিশু
- মানে! আশ্চর্য হয় লিমন
- আম্মু নারকেলের নাড়বানিয়ে রেখেছিল, সেখান থেকে......
- সেখান থেকে চুরি করে এনেছিস? বলে রাসেল
মিশু হাসতে হাসতে বলে,
- চুরি না, তবে না বলে এনেছি
রাসেল হাসতে হাসতে বলে,
- তোর এই চুরির মাল খেয়ে বিপদে পড়বো নাতো? আন্টি যদি ডেকে নিয়ে রুটি পড়া খাওয়ায়?
রাসেলের কথা শুনে অন্যরা হেসে ওঠেমিশু অভয় দিয়ে বলে,
- আম্মু শুনলে কিছুই বলবে নাসে এটা-ওটা বানিয়ে মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করে
- তাহলে মাঝে মাঝে তার পছন্দ হওয়ার মত কাজ করিসকথাটা বলে অন্যদের মৌখিক সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করে শাকিল
- ভাগ্যে থাকলে পরেও পাবিআগে ঝাল পর্ব শেষ করবলে মুড়ির প্যাকেটা খুলতে থাকে রাসেল
মিশু পেয়াজ ও কাঁচা মরিচ কেটেই এনেছেরাসেল চানাচুরের প্যাকেটটা ছিড়ে মুড়ির প্যাকেটের মধ্যে ঢেলে দিয়ে তাতে পেয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে মেশাতে থাকেমিশুও হাত লাগায় তাতে
চলতে থাকে ঝাল পুর্বতৃপ্তি নিয়ে মুড়ি চাবাতে চাবাতে রাসেল বলে,
- আচ্ছা, শাহীনের খবর কি তোরা কেউ জানিস? ৪/৫ দিন যাব স্কুলে আসে না, মাঝে মধ্যে মাঠে খেলা দেখতে আসতো তাও আসে না
এক মুষ্টি মুড়ি হাতে নিতে নিতে শাকিল বলে,
- হ্যাঁ, তাই তোজ্বর টর হয়েছে বোধহয়
তাদের কথা শুনে মিশু বলে,
- না, জ্বর নাগতকাল একটা কাজে ওদের বাড়ির দিকে গিয়েছিলামওর আম্মুর সাথে দেখা হয়েছিলওর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো ও নাকি এই স্কুলে আর পড়বে নাওকে রহমতপুর স্কুলে ভর্তি করাবেএর বেশি কিছু শুনতে পারেনি, ওর আম্মু ব্যস্ত ছিল
রাসেল মুড়ি চাবাতে চাবাতে বলে,
- ওর তো এমনিতেই চলতে কষ্ট হয়, শুধু শুধু দূরের স্কুলে যাওয়ার কি দরকার?
লিমনের মনে পড়ে যায় সেদিনের কথাসে কিছুটা বিরক্তিবোধ করে বলে,
- ওর যা ইচ্ছে তাই করুক, ওকে কি আমাদের কোনো কাজে লাগে? ওর প্রসঙ্গ বাদ দে, আমাদের আসল কথায় আসিনাটক নিয়ে কার কি পরিকল্পনা তাই বল

মিশু কিছুটা নড়েচড়ে বসে বলে,
- একটা খুব ভালো খবর আছেকথাটা তোদের বলতে ভুলেই গিয়েছিলামএকটা চমক আছে তোদের জন্যরহস্য তৈরির চেষ্টা করে মিশু
- কিসের চমক? প্রশ্ন করে লিমন
- কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবলু ভাই হাজির হবেন এখানেতিনি এখন আমাদের এরিয়ার পোস্টিং নিয়ে এসেছেন
রাসেল হাতের মুড়িটা মুখে দিতে গিয়ে আবার নামিয়ে একটু ভাবুক দৃষ্টি নিয়ে বলে,
- মানে ঐ যে নাট্যদলের সাথে থাকতেন ঐ বাবলু ভাই?
- হ্যাঁ, পরশুদিন বাজারে দেখা হয়েছিলউনি তো চাকুরির সুবাদে সিরাজপুর থাকতেনদিন আগে নাকি এই এরিয়ায় ওনার দায়িত্ব পড়েছেআমাদের পরিকল্পনার কথাটা শুনে বেশ খুশি হয়েছেন, উনাকে বলেছি আমাদের নাটকটা আপনাকে পরিচালনা করতে হবে
-উনার কাছে নিশ্চয় নাটকের স্ক্রিপ্ট থাকতে পারেতাহলে আমাদের জন্য আরও ভালো হবেবলে লিমন
- হ্যাঁ, তাতো থাকতেই পারেতিনি পরিচালনা করলে কাজটা আমরা ভালোভাবে করতে পারবো
হঠা পেছন দিক থেকে শোনা যায়,
- ঐ ছেলেরা, আমাকে রেখেই খাবার-দাবার শেষ করছো! তোমরা তো আচ্ছা পেটুক
মিশু তাকিয়ে দেখে বাবলু ভাই হাজিরসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
- আসেন ভাইয়া, মরিচগুলো এখনো শেষ হয়নি, কয়েকটা বাকি আছে
বাবলু ভাই হাসতে হাসতে বসে পড়েমিশু নাড়র প্যাকেটটা খুলে সামনে রাখে
খাওয়া দাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ নাটক বিষয়ে কথা হয় বাবলু ভাইয়ের সাথেতিনি জানান যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক করতে চাওয়ায় তার বেশি ভালো লেগেছেতিনি আরো জানালেন এ বিষয়ক তার কাছে যে কয়টা নাটকের স্ক্রিপ্ট ছিল তার মধ্য থেকে বাছাই করে একটা সাথে নিয়ে এসেছেনতিনি তার ফাইলটা খুলে স্পাইরাল বাইন্ডিং করা একটা স্ক্রিপ্ট বের করলেনসবার নজর এখন সেটার দিকেতিনি স্ক্রিপ্টের একটা পাতা উল্টিয়ে বললেন,
- এই নাটকটাতে যে কয়টা চরিত্র অথা যারা যে নামে অভিনয় করবে তা লেখা আছেএখানে ক্রমিক দিয়ে নয় জনের নাম আছেএই নয় জনই সম্পূর্ণ নাটকটিকে অভিনয় করবেতাই প্রথম কাজ হচ্ছে এই স্ক্রীপ্টের নয়টা কপি করে তোমরা যে নয় জন অভিনয় করবে তাদের প্রত্যেকের কাছে একটা করে দেয়াসবাই নাটকের পটভূমি পড়বে এবং যে যে চরিত্রে অভিনয় করবে সেটা ভালোভাবে পড়ে নিবেচরিত্রে রূপদানের প্রয়োজনে বেশ কিছু জিনিস পত্র লাগবেকিছু জিনিস নিজেদের ম্যানেজ করতে হবে, আর কিছু জিনিস বাজার থেকে কিনে আনতে হবেকি কি লাগবে তা তোমরা নাটকের কাহিনীটা পড়লেই বুঝতে পারবেআপাতত কাজ- এটা নয় সেট ফটোকপি করাআগামীকাল আমরা আবার বসবোআজ আমাকে উঠতে হবে, আমার আরেকটি কাজ আছে
সবাই মনোযোগ সহকারে বাবলু ভাইয়ের কথা শুনছিলবাবলু ভাইয়া ব্যস্ত থাকায় আলোচনা সভা আজকের মত মূলতবী করা হয়


সময়ের সাথে সাথে নাটকের কাজও এগুতে থাকেবাবলু ভাই প্রতিদিন বিকালে এসে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেনবাবলু ভাইয়ের কথা নজরুল স্যারের কান পর্যন্ত চলে গেছেবাবলু ভাই এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হওয়ায় স্যার আগে থেকেই তাকে চেনেনলিমনকে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্যার বললেন, 
- লিমন, তোদের নাটকের খবর কি?
- ভালো স্যারবাবলু ভাই থাকায় কাজটা অনেক সহজ হচ্ছেনাটকের বইসহ নানান জিনিসপত্রও তিনি ম্যানেজ করে দিয়েছেনতিনি আমাদের সবকিছু দেখিয়ে দিচ্ছেনগতকাল বিকালে ক্লাব ঘরে মহড়া দিয়েছিলামআরো একদিন দিতে হবে
- ভালোভাবে কাজ করনাটক ভালো লাগলে একটা বড় পুরস্কার দেব তোদের
কথাটা বলে স্যার চলে গেলেনস্যারের কথা শুনে লিমন খুশি হয়

পরের দিন বিকালে আবারও ক্লাব ঘরে হাজির হয় নাটক গ্রুপের সদস্যরাআজ চূড়ান্ত অনুশীলন হবেআগামী কালই মঞ্চস্থ করা হবে
কাজ করতে বেশ ভালোই লাগে লিমনেরসব অভিনেতা-অভিনেত্রীই তাদের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীতাই কাজ করতেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেবৃহস্পতি বারের সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে বহুবার একক অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেতাই অভিনয়ের ক্ষেত্রে খুববেশি জড়তা বা ভয়ভীতি আসেনিনাটকে লিমনের চরিত্র এলাকার মাতুব্বরলিমন অভিনয়ের মাঝে মাঝে হেসে ফেলেবাবলু ভাই এটা দেখে একবার রাগ করে চলে যেতে চেয়েছিলেনপরে বুঝিয়ে সুজিয়ে আবার শান্ত করা হয়েছে

মহড়া শেষে লিমন বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে তার রুমে বসে স্ক্রিপ্টটা হাতে নিয়ে আবার চোখ বুলাতে থাকেআজ অন্য কোনো কাজ নেই, কাজ শুধু আগামীকালের মঞ্চাভিনয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাকাল নাটকটা হয়ে গেলেই আবার পড়াশুনা শুরু

লিমন স্ক্রিপ্টটা হাতে নিয়ে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছেবেশ রাত হয়ে গেছেএতরাতে ঘরে লাইট জ্বলতে দেখে লিমনের আম্মু তার রুমের কাছে এসে বলে,
- এত রাত পর্যন্ত জেগে কি করছিস?
- নাটকের কিছু বিষয় একটু দেখে নিচ্ছিমনে না থাকলে তো ভালোভাবে করতে পারবো নাতুমি সকালে আমাকে ডেকে দিও, কাল অনেক কাজ আছেসকালে উঠেই ডেকোরেশনের ওখানে যেতে হবেওদের কাছে না গেলে আসতে দেরি করবে
- ঠিক আছে দেব, বেশি রাত জাগার দরকার নেই, ঘুমিয়ে পড়
লিমনের আম্মু চলে যায়লিমন তার মতই স্ক্রিপ্ট দেখতে থাকেসে মনে মনে নিজেকে আরো ভালোভাবে তৈরি করতে থাকেআগামীকালের সম্ভাব্য একটি খন্ডচিত্র তার কল্পনায় ভেসে ওঠে- পরিপাটি মঞ্চসামনে উসুক দর্শকপ্রতীক্ষার প্রহর শেষে মঞ্চের পর্দা ওঠেআধো আলো, সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা মিউজিকধীর পায়ে তার মঞ্চে প্রবেশ...লিমনের চোখ ঢুলুঢুলু করতে থাকেএক সময় সে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়


চোখ খুলতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করে লিমনমাথার কাছে বসা তার আম্মাসামনে নজর করতেই একে একে দেখা মেলে রাসেল, শাকিল, মিশু ও মারুফপ্রথম দেখায় তাদের এভাবে দেখে সে হকচকিয়ে গেলেও আস্তে আস্তে মনে পড়ে যায় সকালের কথাগুলোসকালে সাইকেল নিয়ে ডেকোরেশনের দোকানে গিয়েছিলসবকিছু ঠিক করে মালসামানা ভ্যানে নিয়ে সে পেছনে পেছনে সাইকেল চালিয়ে আসছিলমনের ভিতর নাটক কেন্দ্রিক নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলফুরফুরে মেজাজে সে সাইকেল চালাচ্ছিলসোনাখালীর মোড়ে এসে হঠা কী যেন হয়ে গেলবাম পাশের রাস্তা থেকে একটা মাইক্রোবাস দ্রুত গতিতে আসেগতি বেশি থাকায় গাড়ীটি ঘোরানোর সময় মুহুর্তের মধ্যে তার মুখোমুখি হয়বেশ জোরে একটা শব্দ আসে তার কানেসঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা ধাক্কা অনুভব করে, মাথাটা ঘুরতে থাকে, আস্তে আস্তে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসেআর কিছু মনে করতে পারে না

লিমনকে চোখ খুলতে দেখে রাসেল এগিয়ে আসে তার বেডের কাছেসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
- এখন কেমন লাগছে লিমন?
লিমন কিছু না বলে এদিক ওদিক তাকায়তার চাহনী যেন বলে দিচ্ছে আমি এখানে কেন? রাসেল লিমনকে এভাবে তাকাতে দেখে বলে,
- সোনাখালীর মোড়ে মাইক্রোবাসের সাথে ধাক্কা লেগে তুই পড়ে গিয়েছিলিতেমন কিছু হয়নি, একটু সুস্থ হয়েই বাড়ী যেতে পারবি
লিমনের মনোভাব বাড়ানোর জন্যই কথাটা বলালিমনের পায়ে বড় ধরনের চোট লেগেছেসেসময় বিদ্ধস্ত অবস্থায় লিমনকে দেখে সে নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছিলখবরটা তাকে মিশুই দিয়েছিলসে কি যেন এক কাজে ওখানে গিয়েছিলমানুষের সোরগোল দেখে সামনে গিয়েই লিমনকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে যায়কাছেই লিমনের মেজ চাচার দোকান ছিলসে দ্রুত ছুটে এসে লিমনের চাচাকে খবরটা দেয়তিনি দ্রুত ছুটে যান সেখানেতিনি মিশুকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছোটেনপথিমধ্যে দেখা হয়ে যার রাসেলের সাথেতখন সেও তাদের সাথে হাসাপাতালে আসে 

খবরটা পাওয়ার সাথে সাথে লিমনের আব্বা আম্মাও ছুটে আসেলিমনদের পরিবারের প্রায় সবাই এখন হাসপাতালেজ্ঞান ফিরলেও আশঙ্কামুক্ত নয়লিমনের আব্বার মনটা খুবই খারাপডাক্তারের কথাটা শোনার পর তিনি বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন

রাত পার হয়এক্সের রিপোর্ট আশাব্যঞ্জক নয়ডাক্তার জানায় সময় ক্ষেপন না করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়াই ভালোজাতীয় অর্থোপেডিকে নিলে ভালো হবেপ্রাইভেটেও নিতে পারেন, তবে সেখানে খরচের অংকটা অনেক হয়ে যাবে

বিষণœভাবে সময় যায় লিমনের আব্বা আইয়ুব আলীরমেজ ভাই আসলাম হোসেন পাশে এসে দাঁড়ায়তিনিও এই মুহুর্তে করণীয় বিষয় ভেবে পাচ্ছেন নালিমনের ছোট চাচা আশরাফ ঢাকায় থাকেদুর্ঘটনার কথা তাকে গতকালই জানানো হয়েছিলডাক্তারের কথাগুলো লিমনের আব্বা তার ছোট ভাইকে জানালেনতিনি সব শুনে লিমনকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেনদেরি করা ঠিক হবে না ভেবে লিমনকে সে দিনই ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয় 


নাটক আর করা হলো নাযে সময়টা মঞ্চ বানানো বা অনুশীলনে ব্যস্ত থাকার কথা সেই সময়ে সবাই হাসপাতালে লিমনের পাশেলিমনের দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়তাছাড়া নাটকের মধ্যে তার গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্র ছিলনতুন কাউকে সেই চরিত্রের জন্য তৈরি করাও এত অল্প সময়ে সম্ভব নয় 

পাঁচ দিন হলো লিমন স্কুলে আসে নাতার কারণে ক্লাসে কিছু কিছু সমস্যা হচ্ছেকারণ সে ক্লাস ক্যাপ্টেননজরুল স্যার প্রায়ই লিমনের খোঁজ খবর নেন ছাত্রদের কাছ থেকেস্যার জানালেন যতদিন লিমন সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে না আসে ততদিন পর্যন্ত একজন ভারপ্রাপ্ত ক্লাস ক্যাপ্টেন বানানো দরকারতিনি ঘোষণা দিলেন এক থেকে দশ পর্যন্ত যাদের রোল তাদের মধ্য থেকে একজনকে এই দায়িত্ব দেয়া হবেলিমনের রোল ছিল দুইকোনো কোনো স্কুলে এক রোলধারীকে ক্লাস ক্যাপ্টেন বানানোর রীতি থাকলেও নজরুল স্যার এটাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেন নাতিনি মনে করেন শুধু মেধাবী হলেই সে ভালো পরিচালনা করতে পারবে এর কোন মানে নেইতাই এই স্কুলে এমন রীতি চালু করা হয়নিস্যার সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,
- তোমরা যার যার মত করে ছোট্ট কাগজে একটি করে নাম লিখে আমার কাছে দিয়ে যাওযে নামটা বেশিবার থাকবে অর্থা বেশি ভোট পাবে সে-ই ভারপ্রাপ্ত ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হবে 
স্যারের কথা মত সবাই নিজের পছন্দমত নাম লিখে স্যারের কাছে জমা দেয়স্যার সবগুলো কাগজ দেখে বললেন,
- ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই চায় ভারপ্রাপ্ত ক্লাস ক্যাপ্টেন হোক রাসেলসবচেয়ে বেশিবার এসেছে রাসেলের নাম
সবাই করতালি দিয়ে বরণ করে নেয় রাসেলকেক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচন শেষে স্যার যথারীতি ক্লাসের নিয়মিত পাঠদান শুরু করলেন


আগের মত প্রতিদিনই মাঠে খেলা হয়, বকুলতলায় আড্ডা হয়সবাই আছে, নেই শুধু লিমনলিমন শুধু ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে নয় খেলাধুলার ক্ষেত্রেও তার কাঁধে বেশ দায়িত্ব থাকেতাই অনেকেই তার অভাববোধ করছেলিমনের দায়িত্বগুলো এখন রাসেলের  উপরখেলা শেষ করে সবাই বকুলতলার দিকে যেতে থাকেরাসেল পেছনের দিকে তাকিয়ে মানিককে ডাক দিয়ে স্টাম্পগুলো নিয়ে আসতে বলেমানিকও বকুলতলার দিকে যাচ্ছিলরাসেলের কথা শুনে সে ষ্টাম্প আনার জন্য আবার ফিরে আসেমানিক বন্ধু মহলে মানিক নামে পরিচিতি পেলেও তার আসল নাম মানিক নয়, আসল নাম শরিফুলতার গায়ের রং উজ্জ্বল কালো হওয়ায় অনেকে তাকে কালু নামে ডাকতোপরবর্তীতে এটা সংস্করণ করে পেলের নামানুসারে কালো মানিক ডাকার রীতি চালু হয়যদিও সে ফুলবল খেলা খুব একটা পারে নাশুধুমাত্র শাহীনই শরিফুলকে কালু কিংবা মানিক কোনোটাই না ডেকে আসল নাম ধরে ডাকতোশাহীন এখন আর এই স্কুলে না আসায় বন্ধুদের মধ্য থেকে শরিফুলের আর আসল নামে ডাক শোনা হয় না

হঠা মারুফ সামনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায়সকলেই সেদিকে তাকায়সবার মধ্যে যেন একটা সুখানুভূতি তৈরি হয়কলু বুড়াকে দেখলে এলাকার প্রায় সকল ছেলেদের মধ্যে হাসাহাসির নতুন মাত্রা যোগ হয়কাধে ঝোলা নিয়ে ধীর পায়ে মাঠের মধ্যে প্রবেশ করে কলু বুড়াসে একজন ভিক্ষুকবিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করে বেড়ায়এই এলাকাতেও আসে সপ্তাহে দুএক বারতবে কোথাও দুষ্টু পোলাপানের দেখা পেলে নিরাপদ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করেমাঠের অপর পাশের বাড়িগুলোর দিকে যাওয়ার জন্য পথের দূরত্ব কমাতেই কলু বুড়া মাঠের মাঝ দিয়ে যাওয়ার মনস্থির করেতাকে দেখা মাত্রই মাঠের মধ্যে থাকা ছেলেগুলো হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে আসে তার দিকেহঠা রাসেল বেশ জোরে সোরে বলে,
- মিশু রশিটা জলদি নিয়ে আয়, কলু বুড়া চলে গেল তো.......
কথাটা বলেই সবাই যেন একটু তাড়াহুড়া ভাব দেখায়বুড়া ছেলেগুলোর কথা শুনে পেছনে একবার তাকায়, তারপর তার চলার গতি অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়মিশু বলে,
- কই রাসেল, নিয়ে আয় বুড়া চলে গেল তো....
তারা একে অপরকে রশি আনার কথা বলেবুড়া ভয়ে ভয়ে আরো জোরে হাঁটতে থাকে
এলাকার সকলেই জানে বুড়ার মধ্যে একটা ভীতি আছেতার ধারণা তাকে সত্যিই বেঁধে রাখা হবেকি কারণে তার মধ্যে এই ভীতি তা কেউই জানে নাহয়তো কোন এক সময় বিশেষ পরিস্থিতে তাকে বেঁধে রাখার হুমকি দেয়া হয়েছিল, সেটা এখানো তাকে তাড়া করে ফেরেআর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মজা পায় দুষ্টু ছেলেরাছেলেগুলোর কথা শুনে বুড়া সামনের কটা বাড়ি থেকে ভিক্ষা পাওয়া আশা ছেড়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায়বুড়ার সম্মুখপানে ছুটে চলার এই তাড়না দেখে ছেলেগুলো বেশ মজা পেতে থাকে



লিমনদের বাড়ীতে সকাল থেকে অনেক মানুষ এসেছেবাইশ দিন পর আজ লিমন বাড়ী ফিরেছেবারান্দার খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে আছে লিমনতার বাম পাশে ওয়ালের সাথে দুইটা স্টিলের ক্রাচ রাখাডাক্তারের কথামত আপাতত তাকে ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হবেযদিও সে চলাচল করার মত সুস্থ হয়নি তারপরও একেবারেই হাঁটাচলা না করলে তাতে আরো বেশি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকায় একটু একটু করে হাঁটা চলা করতে বলা হয়েছে

স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই দেখতে এসেছেকেউ কেউ হাতে ফলফলাদীও এনেছেএতদিন পর তাদেরকে দেখে লিমনেরও বেশ ভালো লাগছেসহপাঠীরা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যাওয়ার সময় লিমনকে বিকেলের দিকে আস্তে আস্তে মাঠের দিকে যাওয়ার জন্য বলে, তাতে তার মনটা ভালো লাগবেলিমনের বাড়ী থেকে মাঠের দূরত্ব খুব বেশি নয়রাসেলের কথা শুনে লিমনের মা জানায় আরেকটু সুস্থ হোক তারপর যাওয়া যাবে

দিন পার হতে থাকেলিমন এখন অনেকখানি সুস্থক্রাচ ছাড়াই হাঁটতে পারেতবে তার মাঝে আগের সেই চঞ্চল লিমনকে খুঁজে পায় না তার মালিমন যখন হাঁটে তখন তিনি বিষণœ মনে লিমনের দিকে তাকিয়ে থাকেনলিমন চঞ্চল প্রকৃতির ছিলতার মা প্রায়ই বলতেন আস্তে হাঁটতে পারিস না?’ এখন আর বলতে হয় নাকিন্তু তিনি যেন মনে মনে ভাবেন যদি আবারও তাকে আগের মত বলতে পারতেন

ধীরে ধীরে পায়ের ব্যথাটা কমে আসে লিমনেরএখন আর চলার সময় ব্যথা অনুভব হয় নাঅনেকদিন স্কুলের বন্ধুদের সাথে দেখা হয় নালিমন স্কুলের যাওয়ার জন্য মনস্থির করে

প্রায় আড়াই মাস পর স্কুলে আসে লিমনপ্রথম সারির বেঞ্চে একটি আসন তার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছেএই বেঞ্চটাতেই বেশিরভাগ সময় লিমন, মিশু ও রাসেল বসতোলিমনের অনুপস্থিতিতে এতদিন ভারপাপ্ত ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেছে রাসেললিমন ফিরে আসায় তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে কি না তা জানার জন্য জিজ্ঞাসু ভঙ্গীতে মারুফ বলে,
- লিমন তো আমাদের মাঝে চলে এসেছে, এখন থেকে সে কি তার দায়িত্ব পালন করবে?
পাশ থেকে মানিক বলে,
- দায়িত্ব এক/দুই দিন পর থেকে নিলেই ভালো হবে
লিমন আগের তুলনায় অনেকখানি চুপচাপনিজের ক্লাসের ও অন্য ক্লাসের ছেলেরা এসে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছেলিমন যথাসম্ভব কম কথা বলে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছেঅনেকে আবার কিছু না বলে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেপায়ের দিকে তাকিয়ে থাকার যথেষ্ট কারণ আছেলিমনের ডান পায়ে একটু সমস্যা রয়েই গেছেচোট লেগে গোড়ালীর সংযোগস্থলের অস্তি ফেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তা সম্পূর্ণভাবে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসেনিফলে স্বাভাবিকভাবে ফোল্ডিং না হওয়ায় লিমন ভালোভাবে পা পাততে পারে নাহাঁটার সময় সহজেই একটা অস্বাভাবিকতা নজরে পড়ে

ক্লাস শুরু না হওয়ায় সবাই বারান্দায় বের হয়ে হাঁটাহাটি করছিলঘন্টা পড়ে যাওয়ায় সবাই ভিতরে ঢুকে পড়েতাদের সাথে লিমনও ভিতরে যায়


সাত মিনিট আগে ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়লেও নজরুল স্যার এখনও ক্লাস শেষ করেননিতার ক্লাসে মাঝে মধ্যে এই সমস্যাটা হয়ঘন্টা পড়ার পরও তিনি ক্লাস শেষ করেন নাঅবশ্য এটা ইচ্ছাকৃত নয়, স্যার একটু কানে কম শোনেনহয়তো আজও তিনি ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পাননিস্যার চশমার উপর দিয়ে বইয়ে কি যেন খুঁজছেনহঠা ঘটির দিকে তাকিয়ে বললেন,
- ওই ছেলেরা, ঘন্টা পড়ে গেছে কিন্তু তোরা আমাকে বলিসনি তো!
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলেনঘন্টা পড়ার কথা ছাত্র-ছাত্রীরা জানার পরও তা না বলার পেছনে একটা কারণ আছেকোনো একদিন ঘন্টা পড়ার পরও স্যার ক্লাস শেষ না করায় রাসেল স্যারকে ঘন্টা পড়ার কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়ায় তিনি তাকে ফাঁকিবাজউপাধি দিয়ে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির (মেয়েদের দিকে ফিরে কান ধরা) রায় দিয়েছিলেনতারপর থেকে আর কেউ স্যারের সাথে সময়ের ব্যাপারে কথা বলে নাতারা মনে করে মেয়েদের দিকে ফিরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বাড়তি টাইমে ক্লাস করা অনেক ভালো

স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতেই রাসেল বলে,
- স্যারের যেটা দরকার সেটা না কিনে যেটা না হলেও চলে সেটা কিনে বসে আছে
- কি কিনে বসে আছে? কৌতুহল নিয়ে বলে মিশু
- এই যে দ্যাখ, স্যার চশমা ছাড়া দিব্যি দেখতে পায়, বইও পড়তে পারে অথচ যেটা তার দরকার সেটার খবর নেই
- কোনটা দরকার স্যারের? মিশুর চোখে মুখে কৌতুহল
- স্যারের চশমা না হলেও চলে, তার দরকার হিয়ারিং এইডএটা থাকলে ঠিকমত ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পেতেন, তাহলে আর বেশি সময় নিয়ে তার ক্লাসে বসে থাকতে হতো না
কথাটা শুনে মিশুর হাসি পায়সে হাসি হাসি মুখে বলে,
- চোখের সমস্যা হলে মানুষ সহজেই চশমা নিতে চায় এমনকি সমস্যা না হলেও অনেকে ইচ্ছে করে নেয় অথচ কানের সমস্যা হলে কানের যন্ত্র নিতে চায় নাএটা ব্যবহার করতে মানুষ লজ্জাবোধ করে, এ কারণেই হয়তো স্যার এটা ব্যবহার করে না
সহপাঠীদের কথা শুনে আলাপে অংশ নেয় রাজিবও,
- আসলে চ...চশমা একটা ফ্যা.... ফ্যা.....ফ্যাশন
হো হো করে হেসে ওঠে সবাইরাজিব লজ্জিত হয়, সে আস্তে করে সরে আসেরাজিব সব সময় কম কথা বলেতার কথা রসাত্বক বা হাস্যকর না হলেও অন্যরা তা শুনে হাসেমাঝে মাঝে সহপাঠীরা মজা পাওয়ার জন্য তাকে খুচিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করেএমনটা একসময় লিমনও করেছেসবাই রাজিবের কথা নিয়ে হাসাহাসি করলেও লিমনের কেন জানি এটা নিয়ে মজা করতে ভালো ভাগেনি


অনেকদিন পর আজ মাঠে এসেছে লিমনএকটা সময় ছিল যখন বিকেলে এখানে না আসলে সেদিনটাই যেন অপূর্ণ থেকে যেত, অথচ আজ কতদিন হলো এখানে ছোটাছুটি করা হয় না, খেলাধুলা করা হয় নাএতদিন পর আজ আবার খেলা করতে পারবে ভেবে লিমনের মনটা বেশ ভালো লাগছেঅবশ্য লিমন জানে তারপক্ষে আগের মত আর ছুটাছুটি করা সম্ভব নাসে ক্রিকেট এবং ফুটবল দুটাতেই পারদর্শী ছিল 

মাঠের মধ্যে সবাই খেলোয়াড় ভাগাভাগি করছেলিমন মাঠের এক পাশে বসে আছেরাসেল লিমনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
- লিমন, তুই কি খেলবি?
লিমন মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়তার সম্মতির কথা জেনে রাসেল তাকে মাঠের ভিতরে আসতে বলেলিমন উঠে গিয়ে যোগ দেয় তাদের সাথে
বেশ অনেকদিন পর খেলা করছে লিমনঅনেক কিছুই যেন নতুন নতুন লাগছে
খেলা চলতে থাকেলিমন ব্যাটিং করতে গিয়ে অল্প কটা বল খেলেই আউট হয়ে যায়সে এত সহজে আউট হয়ে যাওয়ায় সতীর্থদের মাঝে অসন্তুষ্টির ছাপ ফুটে ওঠেফিল্ডিংয়ের সময়ও একই কাজ হলোআগের মত স্বাভাবিকভাবে দৌড়াতে না পারায় ফিল্ডিংয়েও ভালো করতে পারলো নাএক পর্যায়ে খেলা শেষ হয়লিমনের দল হেরে যায়অনেকেই লিমনের খারাপ খেলার জন্য অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেলিমন কিছু বলতে পারে না


গোসল করে রুমে ঢুকে বেডের উপর নজর করতেই লিমন কিছুটা চমকে ওঠেএকটি জিনসের প্যান্ট ভাজ করে রাখালিমন দ্রুততার সাথে ওটা হাতে নিয়ে খুলে ফেলেতার মনটা খুশি খুশি লাগেমাস দুয়েক আগে তার খালাত ভাইকে এমন একটি প্যান্ট পরতে দেখে তার আব্বার কাছে বায়না ধরেছিল এমন একটি প্যান্ট তাকেও কিনে দিতে হবেএর কিছুদিন পরেই দুর্ঘটনা ঘটেফলে প্যান্ট বিষয়ক আর কোন কথা আব্বাকে বলা হয়নিতাছাড়া এর মধ্যে এতগুলো টাকায় খরচ হয়ে যাওয়ায় লিমনও ওটা নিয়ে আর কথা বলেনি

লিমন প্যান্টটা হাতে নিয়ে ছুটে যায় মায়ের কাছেমায়ের কাছ থেকে জানা যায় গতকাল রাতে তার আব্বা নিয়ে এসেছিলরাতে সে ঘুমিয়ে পড়ায় তাকে আর ডাকেনিলিমন নিজ রুমে এসে নতুন প্যান্টটা পরে বইয়ের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে রওনা হয় স্কুলের উদ্দেশ্যেআজ মনের মধ্যে অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করছেলিমনের কেন জানি মনে হচ্ছে তার খালাত ভাইয়ের পরনে সেই প্যান্টটা দেখে তার যেমনটা মনে হয়েছিল তার প্যান্ট দেখে তার সহপাঠীদের মধ্যেও একই রকম অনুভূতি কাজ করবেকেউ হয়তো বলবে দারুণ হয়েছে প্যান্টটা, কেউ বলবে তোকে বেশ মানিয়েছে

ক্লাসের মধ্যে ব্যাগটা রেখে লিমন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়অনেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেকয়েক মাস আগেও লিমন এ সময়টায় দারুণ আড্ডায় মেতে থাকতোএখন আর আগের মত তাদের সাথে মেশা হয় নালিমন খেয়াল করেছে তার প্রতি সহপাঠীর দৃষ্টিভঙ্গী যেন আগের মত নেইতাই যথাসম্ভব সেও একটু নিরিবিলি থাকতে চায়কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল মারুফ ও কামালকামালের নজর পড়ে লিমনের প্যান্টের দিকেসে মারুফকে ইশারা করে বলে,
- খোড়াটার অবস্থা দেখ, যেইনা পায়ের ঢং তাতে আবার নতুন ডিজাইনের প্যান্ট
কথাটা বলে সে মিটিমিটি হাসতে থাকেকামালের কথাটা লিমনের কান পর্যন্ত পৌঁছায়কথাটা শোনা মাত্রই সে যেন কিছুটা শক্ড হয়এমন একটা ধাক্কা খেতে হবে ভাবেনি সেএ ধরনের কথায় যে ধাক্কা খেতে হয় তাও জানা ছিল নালিমনের মনে পড়ে যায় একবার শাহীনের নতুন জুতা কেনা নিয়ে তারা অন্য সব বন্ধুরা মিলে বেশ মজা করেছিলশুধু একবার নয়, বহুবার শাহীনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়ে মজা করা হয়েছেকখনো মনে হয়নি এর কারণে কারো খারাপ লাগতে পারেওদের কথাটা শোনার পর নিজের অনুভূতির আলোকে ভাবনা জাগে- তাহলে কি শাহীনও তার মত এভাবে শক্ড হতো? তাদের থেকে আড়াল হওয়ার জন্য লিমন রুমের মধ্যে চলে যায়

রুমের মধ্যে বেশ কয়েক জন সহপাঠী বসে কথা বলছেতাদের মধ্যে রাজিবও বসা আছেরাজিব সাধারণত চুপচাপ থাকেতবে আলাপচারিতায় তাকে নেয়ার জন্য তাকে জড়িয়ে কেউ কেউ কথা বলছেতাদের কথার প্রেক্ষাপটে সে যখন দুএকটি কথা বলছে তখন তার মুখে কথা আটকে গেলেই অন্যরা হাসাহাসি করছেরাজিবের প্রকাশভঙ্গীর দুর্বলতা যেন তাদের আনন্দের খোরাক জোগাচ্ছেলিমন খেয়াল করে, তাদের হাসাহাসির কারণে রাজিব কিছুটা বিব্রতবোধ করছেকিন্তু অন্যদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেইসবাই রাজিবকে কেন্দ্র করে কথা বললেও শাহীন কখনো তা করতো নাকেন করতো না? আজ কিছুটা অনুমান করতে পারছে সেলিমন ভাবুক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাজিবের দিকেতার দিকে তাকিয়ে থেকে তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে 


টিফিনের ঘন্টা বাজতেই সকল ছাত্র-ছাত্রী বাইরে বেরিয়ে পড়েপ্রতিদিনই টিফিনের সময় ফুটবল খেলা হয়লিমন স্কুলের সিঁড়ির উপর বসে খেলা দেখছেমাঝে মাঝে তার বেশ খারাপ লাগে, এক সময় সেও ভালো খেলা করতোনজরুল স্যার তাকে অনেক বার পিঠ চাপড়ে দিয়েছেনস্যার একদিন বলেছিলেন তুই একদিন অনেক বড় খেলোয়াড় হবিঅথচ বছর না ঘুরতেই স্যারের সেই কথা ব্যর্থতায় নিমর্জিত হলো

নজরুল স্যার তাকে এখনো খেলা করতে বললেও লিমন খেলতে চায় নাসহপাঠীরা অবশ্য সরাসরি তাকে না নেয়ার কথা প্রকাশ করে না, তবে তাদের অভিব্যক্তিতে লিমন বুঝতে পারে তারা তাকে সতীর্থ হিসেবে নিতে আগ্রহী নয়গ্রুপ করে খেলা করায় দলের যেন পরাজয় না হয় সে কারণেই দুর্বল খেলোয়াড়দের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী চলে আসেলিমন তা অনুধাবন করে নিজেও আর খেলার প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে নাফলে তার এখন আর খেলা করা হয়ে ওঠে নাব্যাপারটা নজরুল স্যার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেনতিনি একদিন মাঠে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
- তোমরা যে এখানে খেলাধুলা করো এর প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু এখানে বিজয়ী হওয়া নয়, প্রধান উদ্দেশ্য শরীর চর্চাদ্বিতীয়ত ক্লাসের পড়াশুনার এক ঘেয়েমী কাটিয়ে কিছুটা এনার্জি পাওয়াতাই হার-জিতের জন্য কেউ কারো প্রতি হিংসা বিদ্বেষ না করে সবাই মিলেমিলে খেলাধুলা করবা
স্যারের কথাগুলো বইয়ের নীতি কথার মতই থেকে যায়, সেগুলো মাঠের মধ্যে বাস্তবায়িত হয় নাপ্রায় প্রতিদিনই খেলোয়াড় বাছাই নিয়ে অথবা খেলা চলার মাঝে ঝগড়া ফ্যাসাদ হয়কে ভালো খেলতে পারে, কাকে নিলে খেলায় জেতা যাবে সেটাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়লিমনের শারীরিক সমস্যা থাকায় এখন আর খেলোয়াড় তালিকায় তার নাম আসে না

ইতোমধ্যে মাঠে খেলা বেশ জমে উঠেছেকোনো একজনকে বলতে শোনা যায় কালু এদিকে দেলিমনের বুঝতে বাকি থাকে না শরিফুলকেই বলা হচ্ছেশরিফুলের গায়ের রঙের কারণে কালো মানিকের সূত্র ধরে তাকে মানিক নামে ডাকলেও তা সব মহলে রূপ পায়নি, কালু ডাকও তাকে শুনতে হয়ক্লাসের মধ্যে অনেকেই তাকে কালু বলে ডাকেগতকাল একটা বিষয় লিমনের নজরে পড়েছিলআসলাম স্যার ক্লাসে আসতে দেরি করছিলেনমেয়েরা আগেই কমন রুম থেকে ক্লাসে চলে এসেছিলশরিফুলের পেছনের বেঞ্চে শাকিল বসা ছিলসে বার বার কালু কালু বলে ডাকছিলকালু বইটা দে, সাজেসন্সটা দেখি, তোর কলমটা দে......তার কথা শুনে মেয়েরা কেউ কেউ তাকিয়ে দেখছিলক্লাসের মধ্যে মেয়েরা থাকায় শরিফুল বেশ বিব্রতবোধ করছিলমুখে কিছু না বললেও তার চেহারার দিকে তাকিয়ে লিমন যেন কিছুটা চাপা ক্ষোভের আভা দেখতে পেয়েছিল

শরিফুল আবারও বল নিয়ে ছুটছেতার কাছে বল গেলেই যেন মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ তাকে আবার কালুবলে হাক দিলইদানিং শরিফুলকে কেউ কালু বলে ডাকলে লিমনের খারাপ লাগে, অথচ কয়েক মাস আগে সে নিজেও তাকে কালু বলে ডেকেছেএকবার এলাকার এক বড় ভাই অনেক মানুষের সামনে শরিফুলকে বলেছিল তুই সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যাবি, নইলে অন্ধকারে মানুষ তোকে দেখে ভূত ভেবে ভয় পেতে পারেতার কথাটা শুনে সবাই খুব হেসেছিল, লিমনও হেসেছিলএখন লিমনের মনে হচ্ছে শরিুফুল না জানি তখন মনে মনে কত কষ্ট পেয়েছিললিমন ভাবে, শরিফুলের এই গায়ের রঙের পেছনে ওর তো কোনো হাত নেই, সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছে করলে তাকেও এমন বানাতে পারতো

বল নিয়ে শরিফুলের দল অপর পক্ষে গোল পোস্টের কাছিকাছি চলে এসেছেবেশ উত্তেজিত পরিস্থিতিহঠা টিফিন শেষের ঘন্টা বেজে ওঠেটিফিনের সময়ের সাথে খেলার সময় নির্ধারিত থাকায় খেলায় সমাপ্তি ঘটে যায়সবাই যার যার ক্লাসের দিকে যেতে তাকেলিমনও ফিরে আসে তার ক্লাস রুমে 


একাকী বাড়ীর পথে হাঁটতে থাকে লিমনএকসময় দল বেধে আড্ডা দিতে দিতে আসা হলেও এখন সে আলাদাই আসেরাস্তার বাঁকটা ঘুরতেই একজন মানুষকে জড়সড় হয়ে বসে থাকতে দেখেসে লোকটির আরো কাছে এগিয়ে যায়লোকটাকে চিনতে কষ্ট হলো নাকলু বুড়াতার চেহারাটা বেশ শুকনা দেখাচ্ছেলোকটা তার পোটলা পুটলি বের করে তার মধ্যে কিছু একটা খুঁজছেখোঁজা শেষ হলে হতাশা ভেসে ওঠে তার চোখে মুখেলিমন তাকে দেখতে থাকেলোকটির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দুপুরে কিছু খায়নি, ক্ষুধার কারণেই বোধহয় কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা তা পোটলার মধ্যে খোঁজ করছিলসময় গড়িয়ে গেলেও সে দুপুরের খাবার খেতে পারেনি, যেখানে গেছে সেখান থেকেই হয়তো দুষ্টু ছেলের দল তাকে বেঁধে রাখার ভয় দেখিয়ে তাড়া করেছে
লিমনও বহুবার এই লোকটিকে নিয়ে মজা করেছেসে সময় নিজের সুখানুভূতিটাই শুধু দেখা হয়েছে কিন্তু এর প্রেক্ষিতে ঐ লোকটির মনোভাব কি হয়েছে তা ভাবা হয়নিলোকটির ক্ষুধার্ত মুখ দেখে তার প্রতি লিমনের সহানুভূতি জেগে উঠছেআগে কোনো সময় এভাবে তাকে দেখা হয়নি
কিছুক্ষণ আগে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, পোলাপানেরা কেউ কেউ বাড়িতে আছে, কেউবা রাস্তার মাঝে আছেএখন লোকটির বাইরে যাওয়াটা ঠিক হবে নাতার ক্ষুধা পেয়েছে, খাবারের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়লিমন লোকটির আরো কাছে এগিয়ে যায়তার সামনে গিয়ে বলে,
- দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেছেন?
লোকটি লিমনের দিকে মুখ তুলে এক নজর দেখে ডানে বামে মাথা নাড়েলিমনের ধারণা মিলে যায়, লোকটির ক্ষুধা পেয়েছে
- আমাদের বাড়ি যাবেন? ঐ যে সামনে ঐ বাড়িটাহাত দিয়ে দেখায় লিমন
বৃদ্ধ লোকটি লিমনের হাত বরাবর তাকায়তারপর মাথা নেড়ে জানায়, যাবে
- তাহলে চলুন
লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে তার পোটলাটা কাঁধে উঠিয়ে নেয়লিমন হাঁটা শুরু করে, লোকটিকে তার পেছনে হাঁটার জন্য ইশারা করে
হঠা পেছন থেকে কার যেন ডাক শুনতে পায় লিমনপেছন ফিরে তাকায় সেমারুফ জোর পায়ে ছুটে আসে তার কাছেপাশে কলু বুড়াকে দেখে সে মিটিমিটি হাসেলিমন বুঝতে পেরে বুড়াকে কিছু না বলার জন্য তাকে ইঙ্গিত দেয়ইঙ্গিত পেয়ে মারুফ চেপে যায়তারপর বলে,
- আজ স্কুলের বেতন দেয়ার জন্য অফিস রুমে গিয়ে শুনলাম স্যারেরা আলাপ করছে ১৬ ই ডিসেম্বরে নাকি আমাদের স্কুলে এমপি সাহেব আসবেন, অনেক বড় অনুষ্ঠান হবেআর হ্যাঁ, নজরুল স্যার হয়তো নাটক করার কথাও বলতে পারেন২৬শে মার্চে তো সব ঠিকঠাক করেও তোর এক্সিডেন্টের কারণে আর হলো নাযাইহোক এবার হবেএমপি সাহেব আসবেন, আয়োজনটা অনেক মজার হবে
লিমন মুগ্ধের মত শুনতে থাকে মারুফের কথাগুলোমারুফের কথা শুনে পেছনের কথাগুলো মনে পড়ে যায়দেখতে দেখতে কীভাবে যেন কয়েকটা মাস পার হয়ে গেলকত আশা ছিল ২৬শে মার্চে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সুন্দর একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হবেকিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হলো না
মারুফের কথায় সম্বিত ফিরে আসে,
- আগামী কাল স্কুলে গেলেই হয়তো ভালোভাবে জানা যাবেযা, বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হ
কথাটা বলে মারুফ পিছন ফিরে হাঁটতে থাকেলিমনও তার বাড়ির পথ ধরে, পেছনে হাঁটতে থাকে বৃদ্ধ লোকটি


মুখে মুখে অনেকেই জেনে গেছে স্কুলে ১৬ই ডিসেম্বরে বড় অনুষ্ঠান করার কথাসময় খুব বেশি বাকীও নেইসপ্তাহ খানেক সময় আছেক্লাসে নোটিশ দিয়ে আরো ভালোভাবে সবাইকে জানানো হলোস্যার নোটিশ পড়ে সবাইকে শোনানোর পর সাইন করে দিলেনদপ্তরী নোটিশ বুক নিয়ে চলে যাওয়ার পর স্যার কিছুক্ষণ এটা নিয়ে আলোচনা করলেনস্যারের আলোচনার সারাংশ অনেকটা এরকম- স্কুলের মাঠের উন্নয়ন ও ভবনগুলো সংস্কারের জন্য এমপি সাহেবের কাছে কিছু অনুদানের আবেদন করা হবেস্যার আরো জানিয়ে দিলেন এদিন তোমরা সবাই অবশ্যই তোমাদের অভিভাবকদেরকে আসতে বলবে
অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলতে থাকেঠিক করা হয়েছে অনুষ্ঠানে প্রত্যেক ক্লাসের ক্লাস ক্যাপ্টেন প্রধান অতিথিকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবেনখবরটা লিমনকে বেশ খুশি করেকারণ সে তো একজন ক্লাস ক্যাপ্টেনসামনের দর্শক সারিতে তার বাবা বসে থাকবে, ব্যাপারটা সত্যিই ভালো লাগারলিমন মনে মনে ঠিক করে তখন একটা ছবি উঠিয়ে রাখবে১৬ই ডিসেম্বরের সারাদিনের অনুষ্ঠান ছাড়াও রাতে আয়োজন করা হয়েছে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিশেষ নাটক
শোনা যাচ্ছে এবার নাকি খুব সুন্দর করে নাটকটা উপস্থাপন করা হবেবাবলু ভাই সেরকমটাই বলেছেনবাবলু ভাইয়ের সাথে রাসেলের ভালো সম্পর্ক আছেতাই স্কুল থেকে নাটকের ব্যাপারটার জন্য রাসেলকেই বলা হয়েছেরাসেল আজ স্কুলে আসেনি, বিকেলে মাঠে গেলে নাটকের অগ্রগতি জানা যাবে

বিকেলে মাঠে হাজির হয় লিমনসবাই বেশ হাসিখুশিলিমনকে দেখে মারুফ রাসেলের উদ্দেশ্যে বলে,
লিমনকে নাটকে নিলে ভালো হতোও তো ২৬ মার্চের সময় মাতুব্বরের চরিত্রে মহড়া দিয়েছিল 
মারুফের কথার রেশ ধরে রাসেল বলে,
-ও তো খোড়া, ও কীভাবে অভিনয় করবে? তবে আমাদের নাটকে খোড়ার কোনো চরিত্র থাকলে করতে পারতো
কথা বলার সময় একটু হাসি পায় তারকিছুটা সংযত হয়ে আবার বলে,
- লিমন তুই একটা কাজ করতে পারিস, ১৬ই ডিসেম্বরে তো যেমন পারো তেমন সাজো’-তে অনেক কিছু সেজে আসা যায়তুই একজন আহত মুক্তিযোদ্ধা সেজে আসবিএকেবারে রিয়েল, দারুন হবে
কথাটা শেষ করে হাসি হাসি মুখ করে রাসেল অন্যদের দিকে তাকিয়ে সমর্থন আশা করেলিমনের মনটা খারাপ হয়ে যায়তার শারীরিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে এভাবে ঠাট্টা বিদ্রুপ করাটা সে মোটেও আশা করেনিতারা কথাগুলো বলে আনন্দ পাচ্ছে আর কথাগুলো শুনে লিমন মনে মনে কষ্ট পাচ্ছেএ ধরনের কথায় যে কারো খারাপ লাগতে পারে সেটা হয়তো তারা ভাবছেও নাহয়তো ভাবার কথাও নাএক সময় ওদের সাথে এমন কথা বলে লিমনও আনন্দ পেয়েছে, সেটা স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া যায়লিমন নিজেও শাহীনকে কত কথা বলে মজা পেয়েছেতখন তো এদের মত সেও শাহীনের কষ্টটাকে দেখতে পায়নিএটা যে কষ্টের তা হয়তো তারা তাদের জায়গা থেকে বুঝতে পারছে না
লিমন নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করেতাদের উপেক্ষা লিমনকে আরো অন্তমুখী করতে থাকে


দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে এসেছেআজ ১৫ তারিখ, রাতটা পার হলেই বিজয় দিবসপ্রায় সকল প্রস্তুতি শেষের দিকেঅনুষ্ঠান পরিচালনার সূচীও করা হয়েছে, সেখানে লিমনের জন্য একটা ধাক্কা খাওয়ার বিষয় ছিল তা লিমন ভাবেনিআগে বলা হয়েছিল প্রত্যেক ক্লাসের ক্যাস ক্যাপ্টেন প্রধান অতিথিকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবেএই পর্বটা অনুষ্ঠান সূচীর মধ্যে ঠিকভাবে থাকলেও তাতে সামান্য একটু পরিবর্তন আনা হয়েছেঅষ্টম শ্রেনির ক্যাপ্টেনের পরিবর্তে দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন অর্থা যে ক্লাসক্যাপ্টের অনুপস্থিতে দায়িত্ব পালন করে তাকে নেয়া হয়েছেঅনুষ্ঠানের দৃষ্টিকটু ভাব এড়াতেই নাকি এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়এই পর্বটিতে মঞ্চের উপর হাঁটা চলার ব্যাপার জড়িত আছে, আর এ ক্ষেত্রে লিমনের দুর্বলতা থাকায় তার পরিবর্তে অষ্টম শ্রেণির পক্ষ থেকে রাসেলকে মনোনিত করা হয়েছে
কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তকে অনেকে স্বাগত জানালেও নজরুল স্যার একমত হতে পারেননিতিনি তা জানিয়েছিলেনওকিন্তু অধিকাংশ সমর্থন বিপক্ষে থাকায় নজরুল স্যারের কথাটি অযৌক্তিক বলে বিবেচিত হয়
খবরটি যখন লিমনের কাছে বলা হয় তখন তাকে বোঝানো হয় অনুষ্ঠানটা সুন্দর করে তোলার জন্যই এটা করা হয়েছেলিমনও নিশ্চয় অনুষ্ঠানের ভালো চায়সে সময় লিমনকে প্রশ্নও করা হয়েছিল- অনুষ্ঠান সুন্দর হোক সে এটা চায় কি না? লিমন উত্তরে বলেছিল- অবশ্যই চায়

রাত পার হয়পূর্ব আকাশে নতুন সূর্য ভেসে উঠে জানান দেয় বিজয় দিবসেরকিন্তু আজ লিমনের মনের বিজয় হলো, নাকি পরাজয় হলো অনেকেরই অজানাস্কুলের মাঠ থেকে মাইকে দেশাত্ববোধক গান ভেসে আসছেলিমনের ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে মাঠে চলে যেতে, কিন্তু এক ধরনের চাপা কষ্ট তাকে ধরে রাখছে

এ সময় ঘরের মধ্যে লিমনকে দেখে তার মা এসে বলে,
- এ সময়ে কেউ ঘরে শুয়ে থাকে নাকি? স্কুলের মাঠে কত রকম খেলাধুলা, অনুষ্ঠান হচ্ছে আর তুই ঘরে কি করছিস?
লিমন চুপ থাকে, কোনো কথা বলে না
- শরীর খারাপ? মায়ের কথায় কিছুটা উদ্বিগ্ন ভাব ফুটে ওঠে
লিমন মুখটা আড়ালে রেখেই বলে,
- শরীর খারাপ না, এমনি যেতে ইচ্ছে করছে না
মা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকেলিমন ঘাড় ঘুরিয়ে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে চলে যাওয়া জন্য বলেতিনি ভাবুক মনে আস্তে আস্তে চলে গেলেন
একটা চাপা কষ্ট যেন ভর করছে লিমনের মনে ভিতরঅনেকের কাছে এটা কষ্ট পাওয়ার মত কিছুই না, নইলে নজরুল স্যারের কথাটা অন্যদের কাছে গুরুত্ব পেততার পরিবর্তে অন্য কেউ মঞ্চে উঠে প্রধান অতিথিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো স্বাভাবিক একটা বিষয়কিন্তু এই উপেক্ষা তার জন্য কষ্টের কারণ হতে পারে তা লিমন কীভাবে বুঝাবে? কী বলবে মায়ের এমন প্রশ্নের জবাবে? তাইতো মাকে উত্তর না পেয়েই এখান থেকে চলে যেতে হলো
নিজের দুর্বলতার কারণে কোনো কষ্ট পেলেই শাহীনের কথা মনে পড়ে লিমনেরএখনও শাহীনের ছবিটা মনের মধ্যে ভাসছেশাহীন সাধারণত স্কুল মিস দিত না, তবে মাঝে মধ্যে হঠা তাকে পাওয়া যেত নাস্কুলে না আসার মত তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণও তারা খুঁজে পেত নাশাহীনকে তারা নানাভাবে উপেক্ষা করতো, তাহলে সেই কষ্টেই কি সে মাঝে মধ্যে এভাবে নিজেকে দূরে রাখতো? প্রশ্নটা আজ লিমনের সামনে এসে দাঁড়ায়
সময় গড়িয়ে যায়বিকেলের সূর্যটার তেজ কমতে শুরু করেছেলিমন এখনও ঘরের মধ্যেসারাটা দিন ঘরের মধ্যে কেটেছে তারলিমনের মা সারাদিন ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকলেও মাঝে মাঝে লিমনের ঘরের সামনে থেকে ঘুরে গেছেনলিমনকে এভাবে দেখে তিনিও কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছেনতিনি আবারও লিমনের কাছে এসে বললেন,
- এমন একটি দিনে সারাবেলা ঘরের মধ্যে কাটালিএখন অন্তত বাইরের দিক থেকে ঘুরে আয়সন্ধ্যার পর তো স্কুলের মাঠে নাটক হবেযা, নাটক দেখে আয়, মনটা ভালো হবে
লিমন চুপচাপ বসে থাকেতাকে এ অবস্থায় দেখে মায়েরও মনটা খারাপ হতে থাকেতিনি লিমনের হাত ধরে দাড় করিয়ে দিয়ে বললেন,
- যা বাবা, বাইরে থেকে ঘুরে যায়
লিমন মায়ের মনের অস্থিরতা বুঝতে পারছেতাকে এভাবে দেখে তার মায়েরও খারাপ লাগছেবাইরে থেকে ঘুরে আসাই ভালো
সাধারণত সন্ধ্যার দিকটাতে এদিকে তেমন মানুষ জন থাকে না, তবে আজ বেশ লোক সমাগম দেখা যাচ্ছেনাটকের কথাটা বেশ প্রচার হয়েছে বোঝা যাচ্ছেধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের ভিতরে চলে আসে লিমনমঞ্চের সামনে অনেক মানুষ বসাদাঁড়িয়েও আছে অনেকেভিতরের দিকে একটু ফাঁকা মত জায়গা দেখে লিমন এগিয়ে গিয়ে সেখানে বসে
মঞ্চ থেকে ঘোষণা আসে, আপনারা সুশৃঙ্খলভাবে বসে পড়, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নাটক শুরু হবে হবেআমাদের নাটকের নাম সোনালী সূর্য
চারিদিকে দর্শকের নানা গুঞ্জন শুরু হয়কেউ কেউ ধৈর্যহারা হয়ে আয়োজকদেরকে দ্রুত শুরু করতে বলেএভাবে আরো কিছুক্ষণ সময় পার হয়মঞ্চের সামনে উসুক দর্শকপরিপাটি মঞ্চ সজ্জাআস্তে আস্তে মঞ্চের পর্দা উঠতে থাকেআধো আলো, সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা মিউজিকধীর পায়ে একজন মঞ্চে প্রবেশ করে, নেপথ্যে লিমনের নাম ধরে কাউকে ডাকতে শোনা যায়নামটা শুনে লিমন কিছুটা অবাক হয়সে নাটকের স্ক্রিপ্ট দেখেছিলসেখানে লিমন নামে কোনো চরিত্র আছে বলে মনে পড়ে নামঞ্চের মাইকে আবারও শোনা যায়,
-লিমন, এ্যা...ই লিমন, ওঠ...


আবারও ডাকটা কানে ভেসে আসে এ্যা...ই লিমন...এবার স্বরটা আরেকটু জোরেহঠা মঞ্চের লাইটের আলো লিমনের চোখে এসে পড়েসে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে তার মা জানালার পর্দা সরাতে সরাতে বলছে- ওঠ..., আর কতক্ষণ ঘুমাবি? এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়? রাতে বললি সকালে আমাকে ডেকে দিও, কাল অনেক কাজ আছেসকালে ডেকোরেশনের ওখানে যাবি বলেছিলিএখনো ঘুমাচিছস!  যাবি না?’
লিমন হতভম্বের মত এদিক ওদিক তাকাতে থাকেকিছুই বুঝে উঠতে পারছে নাহঠা তার পায়ের কথা মনে হয়সে ডান পায়ে শক্তি দেয়ার চেষ্টা করেহাটু থেকে বাকা করে আবার সোজা করেনা, কোনো সমস্যা মনে হয় নাডান পাটা ডানে বামে ঘোরায়না, আসলেই কোনো সমস্যা নেইসে অবাক হতে থাকেধপ করে উঠে দাঁড়ায়পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটাহাটি করেলিমনের আচরণ দেখে তার মা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে বলে,
- কি হয়েছে? এমন করছিস কেন?
লিমন কোনো কথা বলে নাতার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপকিছুক্ষণ সে নীরব থাকেকিছু একটা বলতে গিয়েও আবার থেমে যায়ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায়লিমনের মা ডেকে বলে, ‘কী হলো হাত মুখ না ধুয়ে আবার কই ছুটলিলিমনের ভ্রুক্ষেপ নেই এদিকেতার মা অবাক হয়ে ছেলের ছুটে চলা পথের দিকে তাকিয়ে থাকে

লিমনের দৌড়টা শাহীনদের বাড়ীর গেটের সামনে এসে থামেকিছুটা শান্ত হয়ে বাড়ীর মধ্যে ঢোকেশাহীনের মা বারান্দায় বসে কাপড় সেলাই করছিলেনলিমন উনার কাছে গিয়ে বলে,
- আন্টি শাহীন কোথায়?
- ওর ঘরে আছেলিমনকে দেখে তিনি কিছুটা অবাক হন
লিমন ছুটে যায় সেই ঘরের দিকেঘরের মধ্যে শাহীন বসে কী একটা বই পড়ছিললিমনকে আসতে দেখে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েলিমন ঘরে ঢুকেই শাহীনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেকাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে,
- আমি তোকে কোথাও যেতে দেব নারে শাহীন, কোত্থাও যেতে দেব নাআমরা এক সাথেই পড়বো, এক স্কুলেই পড়বোআমি তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি, তোকে কষ্ট দিয়েছি তুই আমাকে ক্ষমা করে দেআমি তোকে কোত্থাও যেতে দেব না
অঝোরে পানি পড়তে থাাকে লিমনের দুচোখ বেয়েশাহীনেরও চোখ ভিজে যায়সে কিছু বলতে পারে নাকান্নাজড়িত শব্দ শুনে শাহীনের মা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেনলিমনের কথাগুলো শুনে তার চোখেও পানি চলে আসেতিনি আঁচল দিয়ে লুকানের চেষ্টা করলেনতাদের দিকে এগিয়ে এসে কাছে টেনে নিয়ে মায়ার বাঁধনে বাহুডোরে জড়ালেন দুজনকেসে বাঁধনে জড়িয়ে লিমন যেন অনুভব করে ভালোবাসার এক ভিন্ন আবেশ

# # #

(প্রকাশিতঃ শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়া, আগষ্ট ২০১৩ ঈদ সংখ্যা)