চেয়ার অথবা চৌকি-টৌকি ধরনের
কিছু একটা
থাকলে বারান্দায়
একটু বসা
যেত। এমন
ইচ্ছাটা শুধু
আজকে নয়,
যখনই সে
বাইরে থেকে
ক্লান্ত হয়ে
ঘরের বারান্দায়
পা রাখে
তখনই এমনটা
মনে হয়।
তবু এর
ব্যবস্থা করা
হচ্ছে না।
যদিও বারান্দাটা
এমন কোন
সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান নয় বা এখানে
দখিনা বাতাসও
ঢেউ খেলে
না। তারপরও
আদম গাজীর
ইচ্ছে হয়
বারান্দার এক পাশে আসন পেতে
একটু আরামে
বসতে। সেবার
সমস্ত প্রস্তুতি
শেষ করেও
ছোট্ট এ
স্বপ্নটা বাস্তবের
মুখ দেখতে
পারেনি। স্ত্রী
মরিয়মের একটা
চাওয়াকে পাওয়ায়
রূপ দিতে
গিয়েই এমনটা
হয়েছে। অবশ্য
মরিয়ম তাকে
সেটা দেওয়ার
জন্য খুব
করে ধরেনি।
শুধু বলেছিল
'শাড়িটা সুন্দর
তাই না?'
এ কথায়
শাড়ি চাওয়ার
কথা বোঝানো
হয় না,
তবু বলার
ধরণটার মাঝে
আদম গাজী
আশার প্রবণতা
দেখেছে। ছোটবেলায়
আদম গাজী
যখন আব্বার
হাত ধরে
বাজারে যেত
তখন সেখানে
কোন জিনিস
পছন্দ হলে
মনের ব্যাকুলতা
মিশিয়ে সেই
জিনিসটাকে দেখত। তার সৌন্দর্য ও
গুণাগুণ নিয়ে
নানান কথা
উপস্থাপন করতো।
সরাসরি পাওয়ার
প্রস্তাব পেশ
না করেও
কাজ হাসিলের
জন্য পিতার
মনঃসংযোগের চেষ্টা করা হত। ছোটবেলার
এ অভিজ্ঞতার
আলোকেই আদম
গাজী তার
জমানো টাকা
দিয়ে মরিয়মের
পছন্দের শাড়িটা
কিনে দিয়েছে।
শাড়িটা পেয়ে
মরিয়ম খুব
খুশি হয়েছিল।
মরিয়মকে খুশি
করতে পেরে
আদম গাজীরও
কম ভালো
লাগেনি।
শাড়িটা এখনো পরা
হয়নি। মরিয়ম
বলেছিল ধান
রোয়ার কাজটা
শেষ হলেই
বোনের বাড়ি
বেড়াতে যাবে,
তখনই শাড়িটা
পরবে। ধান
রোয়া হয়ে
গেছে সেই
কবে। এখনো
বোনের বাড়ি
যাওয়া হয়নি।
শাড়িটাও শক্ত
ভাঁজে বাঁশের
আড়ায় ঝুলে
রয়েছে। বোনের
বাড়ি যাওয়ার
বদলে মরিয়মকে
হাসপাতালে যেতে হবে আদম গাজী
তা কখনো
কল্পনাও করেনি।
কয়েক মাস
আগে মরিয়মের
একটু একটু
পেট ব্যথা
করতো। আস্তে
আস্তে যখন
তীব্র আকার
ধারণ করলো
তখন পাড়ার
করিমন ভাবী-ই বলেছিল-
"ও আদম
তুমি মরিয়মরে
হাসপাতালের বড় ডাক্তার দেকাও। রশিদির
বউয়ের কতা
মনে আছে?
প্যাট বেতা
কত্তি কত্তি
বউডা মুরে
গেল। মরিয়মরে
তুমি ঐ
পতে ঠিলে
দিও না।"
রশিদের বউয়ের
কথা টেনে
তুলতেই আদম
গাজীর মনটা
চমকে উঠেছিল।
রশিদের আলসেমীতে
বউটা বিনা
চিকিৎসায়
মারা গেছে।
একথা মনে
হতেই আদম
গাজী করিমন
ভাবীর কথা
ফেলে দিতে
পারেনি। ডাক্তারের
পরামর্শ নিয়ে
মরিয়মকে হাসপাতালে
ভর্তি করেছে।
হাসপাতালে মরিয়মকে দেখাশুনা
করার জন্য
প্রতিদিনই দু'একবার তাকে ওখানে
যেতে হয়।
এর দরুণ
মহাজনের কাজে
বেশ অনিয়ম
দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও বিকালের
দিকে ছলিমুল্লার
চায়ের দোকানে
সম বয়সীদের
সাথে গল্প-গুজবের যে
আসর বসে
ইদানিং তাতেও
অনুপস্থিতি হার বেড়ে গেছে। তার
সাথীরা অবশ্য
তাকে ডাকতে
কম করে
না। মাঝে
মাঝে তাদের
উপর আদম
গাজীর বড্ড
রাগ হয়।
বিশেষ করে
কেরামতের উপর।
ঐ ব্যাটাই
তার আদম
আলী নামটাতে
আলীর জায়গায়
গাজী বসিয়েছে।
এজন্যই এখন
সে সমাজে
আদম গাজী
নামেই পরিচিত।
নামের পরে
এমন পদবী
জুড়ে দিলে
কেমন যেন
বয়স্ক বয়স্ক
লাগে। আলী
থাকলে বেশ
ইয়াং ইয়াং
মনে হয়।
তাছাড়া চলিশোর্ধ্ব
মানুষদের ক্ষেত্রেই
এমন পবদী
জুড়তে দেখা
যায়। সেই
তুলনায় অনেক
বাকী আছে
সুতরাং এখনো
তার নামের
সাথে আলী
রাখার সময়
আছে। মরিয়মকে
ঘরে তুলেছে
মাত্র দু'বছর। এখনো
আব্বা ডাক
শোনেনি। আর
এখনই সহযোগী
কর্মীদের এমন
অবিবেচ্য লেজুড়টা
মেনে নিতে
বড্ড কষ্ট
হয়। মাঝে
মাঝে প্রতিবাদ
জানাতে ইচ্ছে
হয় কিন্তু
হাস্যকর পরিস্থিতির
সৃষ্টি হওয়ার
ভয়ে তা
আর করা
হয় না।
আজ হাসপাতালে একটু
আগেই যেতে
হবে। মরিয়মের
এপেন্ডিক্সের অপারেশন কখন করা হবে
সেটা আজকেই
ডাক্তার সাহেব
বলে দেবেন।
পূর্বের এ
ক'দিনে
গাড়িওয়ালাদের হাতে যাতায়াত খরচ দিয়েই
পকেটের অবস্থা
'গড়ের মাঠ'। পকেটের এ অবস্থার
কথা চিন্তা
করে গতকাল
ছলিমুল্লার দোকানে গল্প গুজবের আসরে
হাজিরা না
দিয়ে একটা
সাইকেলের জন্য
সে রশিদে
কাছে গিয়েছিল।
অনেক অনুনয়-বিনয় করে
তার সাইকেলটা
নিয়ে আসা
হয়েছে। আজকের
যাতায়াত খরচটা
আর লাগবে
না। এতে
কতটুকুইবা সাশ্রয় হবে; এখন জিনিসের
যা দাম!
মাঝে মাঝে
রাজনৈতিক দলের
উপর আদম
গাজীর প্রচন্ড
রাগ হয়।
সরকার আর
হরতালকার (বিরোধী দল) মিলে কী
সব তাল
গোল পাকায়
আর দ্রব্যমূল্য
লাফিয়ে লাফিয়ে
বাড়ে। আগে
পকেটে করে
টাকা আর
ব্যাগে করে
সওদা আনা
হত আর
এখন ব্যাগে
করে টাকা
আর পকেটে
করে সওদা
আনার মত
অবস্থা। এসবের
পরিবর্তন কবে
হবে বা
আদৌ হবে
কিনা কে
জানে। মরিয়মের
চিকিৎসার
খরচ চালাতে
গিয়ে মহাজনের
কাছে অনেক
টাকা দেনা
পড়ে গেছে।
সাধের চেয়ারটা
বোধ হয়
খুব তাড়াতাড়ি
আর কেনা
হবে না।
হাসপাতালের সামনে একটা
ফাঁকা জায়গায়
বেশ কিছু
সাইকেল-মটরসাইকেল
রাখা আছে।
আদম গাজী
সাইকেলটা সেখানেই
রেখে ভিতরে
ঢুকে পড়লো।
মরিয়মের কেবিনে
ঢোকার পথে
বেশ কিছু
মানুষের জটলা
দেখা গেল।
কারো কারো
কান্নার সুরও
ভেসে আসছে।
হয়তো কেউ
মারা গেছে
বলে মনে
হল। এটা
হাসপাতাল, প্রায়ই এমনটা হয়ে থাকে
তাই এর
মধ্যে অস্বাভাবিকতার
কিছুই না
পেয়ে সে
মরিয়মের বেডের
দিকে এগিয়ে
গেল। স্বামীর
আগমন দেখে
মরিয়মের মাঝে
কিঞ্চিৎ
সুখানুভূতি ফুটে উঠলো। খাটের পাশের
কাপড়-চোপড়
সরিয়ে দিয়ে
বসার জায়গা
করে দিল।
প্রতিদিনই আসা হয় বিধায় সৌজন্যমূলক
আলাপে না
গিয়েই বলল-
"কান্না-কাটি কেন কেউ মরে
গেছে নাকি?"
জবাবে মরিয়ম
বলল- "হ্যা, গতকাল মহিলাটার এপেন্ডিক্সের
অপারেশন করার
পর আর
জ্ঞান ফেরেনি।"
মরিয়মের উত্তরটা
আদম গাজীর
অন্তরে গিয়ে
আঘাত করে
বসল। এমনটা
হবে জানা
ছিল না।
মরিয়মেরও তো
অপারেশন হবে,
আল্লাহ তাকেও
কাঁদাবেন কিনা
কে জানে।
ওদের পাশে
যেতে ইচ্ছে
হল। মরিয়মকে
"আসছি" বলেই ওদিকে
এগিয়ে গেল
আদম গাজী।
ঐ বেদনাহত
মানুষগুলোর মধ্যে এক জনের কোলে
ছোট্ট একটি
বাচ্চা শুধু
এদিক ওদিক
তাকাচ্ছে। ক্রন্দনরত মানুষগুলো একবার বাচ্চাটির
দিকে তাকাচ্ছে
আরেক বার
লাশের দিকে
তাকাচ্ছে। সম্ভবত ঐ লাশটিই বাচ্চাটির
মা। তাই
যদি হয়
তবে সবচেয়ে
বেশি কাঁদবার
কথা বাচ্চাটির।
অথচ সে-ই কাঁদছে
না মোটেও।
হয়তো এখনো
সে কাঁদবার
কোন কারণ
খুঁজে পায়নি।
ক্ষুধা পেলে
আত্মীয়রা যখন
মায়ের দুধের
বদলে কৃত্রিম
তৈরী দুধ
তার মুখে
ধরবে তখনই
হয়তো সে
প্রতিবাদের ভঙ্গিতে এটা সরিয়ে দিয়ে
মায়ের সেই
নির্ভেজাল দুধের দাবী নিয়ে কান্না
নামক শ্লোগান
তুলবে।
লাশটিকে ভ্যানে তোলা
হয়েছে। এবার
ফিরে আসার
মন মানসিকতায়
মুখ ঘুরাতেই
আদম গাজীর
চোখ পড়ে
যায় সাইকেল
রাখা স্থানটির
দিকে। সাথে
সাথেই চমকে
ওঠে। যেন
নিজের চোখকেও
বিশ্বাস করা
যাচ্ছে না।
নির্ভুল তথ্য
পাওয়ার জন্য
দুই তিন
বার পলক
ফেলে ভালো
করে আবার
তাকালো। ফলাফল
একই। সাইকেলটা
ওখানে নেই।
দ্রুত পায়ে
কাছে গিয়ে
আদম গাজী
হত বিহবল
হয়ে পড়ে।
কাছাকাছি আরো
অনেক সাইকেল
মটরসাইকেল রাখা আছে, শুধু তার
সেই সাইকেলটা
নেই। আশে-পাশে দেখাদেখির
পালাটাও সারা
হল তবু
পাওয়া গেল
না। আদম
গাজীর মনটা
বার বার
দোলা দিয়ে
উঠছে, হয়তো
সাইকেলটা শেষ
পর্যন্ত কোন
দুস্কৃতিকারীর সুখাদ্যে পরিণত হয়েছে। পাশে
দাঁড়ানো কয়েকটা
লোকের মধ্যে
সাইকেল না
পাওয়ার কথাটা
বলার পরও
তাদের মাঝে
তেমন কোন
প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল না। শুধু
দায়সারা গোছের
একটা উত্তর
এল- "এখানে আমরা থেকেও কিইবা
করতে পারি
বলুন, শত
শত সাইকেল
থাকে, কে
কোনটা রেখে
যাচ্ছে নিয়ে
যাচ্ছে অত
ঠিক করে
পারা যায়
না। আপনি
এক কাজ
করুন, চেয়ারম্যান
সাহেবকে কথাটা
জানিয়ে রাখুন।"
তাদের একথায় সামান্য
সহানুভূতি ছাড়া সাইকেল ফিরে পাওয়ার
আশ্বাস খুঁজে
পায়নি আদম
গাজী। মাথা
নিচু করে
মরিয়মের রুমের
দিকে পা
বড়ালো। মরিয়মের
একটা গুণ
প্রায়ই তার
চোখে পড়ে।
কোনো সমস্যায়
সহজেই যে
উত্তরণের পথ
খুঁজে পায়।
এ জন্য
মরিয়মকে তার
খুব ভালো
লাগে। তবে
আজকের এই
বিষয়টা বিস্তারিত
জানার পরও
তার মাঝে
সে রকম
কোন মনোভাব
লক্ষ্য করা
গেল না।
শুধুমাত্র সমব্যথীর সুরে বলল- "এখানে
তোমার তো
পরিচিত কেউ
নেই যে
খোঁজ খবর
ন্যাবে। তুমি
কেন লোকের
সাইকেল নিয়ে
আসলে? ওর
দামও তো
কম না,
এই অসময়ে
এত টাকা
কি কইরে
শোধ করবা।"
মরিয়মের কথা শুনে
আদম গাজীর
মনটা আরো
খারাপের দিকে
গেল। কি
করবে বুঝতে
পারছে না।
কোন কথা
না বলে
উঠে দাড়ালো,
তারপর পা
বাড়ালো পথের
দিকে। মরিয়ম
সেদিকে তাকিয়ে
থাকলেও কোন
কথা বলল
না।
রাস্তার উপর উঠতেই
পরিচিত মোটরসাইকেলটা
এদিকে আসতে
দেখা গেল।
লাল রঙের
গাড়িটিতে চেয়ারম্যান
সাহেব চালক
হিসেবে বসে
আছেন। ইচ্ছে
করলে তাকে
থামিয়ে কথা
বলা যায়।
কিন্তু বলে
কি কোন
লাভ হবে?
মরিয়ম বলতে
নিষেধ করেনি
তবে বলে
কাজ হবে
না বলেছিল।
আসলেই কি
তাই! তবে
কি বলা
ঠিক হবে?
মনটা ভাবুক
হল আদম
গাজীর। রাস্তা-ঘাটে চেয়ারম্যান
সাহেবের সাথে
তার প্রায়ই
দেখা হয়।
চোখাচোখি হয়ে
গেলে বড়জোর
সালাম বিনিময়
হয় তারপর
যে যার
কাজে চলে
যায়। কিন্তু
আজ তার
এমন ভাবনাময়
ও আগ্রহবোধ
চাহনী লক্ষ্য
করে চেয়ারম্যান
সাহেব নিজেই
মটর সাইকেল
থামালেন। বললেন-
"কী ব্যাপার
আদম, এভাবে
দাঁড়িয়ে আছো
কেন, কিছু
বলবে?" আদম গাজী বুঝলো চেয়ারম্যান
সাহেব কিছুটা
হলেও তার
মনের অবস্থা
আঁচ করতে
পেরেছেন। তাই
আমতা আমতা
করেই কথাগুলো
বলে ফেলল।
শুনে চমকে
উঠলেন চেয়ারম্যান
সাহেব। "বল কী আদম! আজকেও
সাইকেল চুরি!
এর আগেও
ওখান থেকে
সপ্তাহ খানেকের
মধ্যে ২টা
সাইকেল চুরি
হয়েছে। আবার
আজকেও আরেকটা!
তুমি বাড়ি
যাও, আমি
ম্মেম্বরদের ডেকে মিটিং করে দেখি
কী করা
যায়।" এ কথা বলার পর
তেমন কোন
কথা বাড়ানো
যায় না।
তাই আদম
গাজী আবার
চলা শুরু
করলো।
পুর্বে রশিদের সাথে
সম্পর্ক মোটামুটি
ভালো থাকলেও
সাইকেল হারানোর
পর থেকে
তাতে শনির
দশা দেখা
দিয়েছে। দেখা
হলেই টাকার
কথা ওঠাতে
ভোলে না।
সাইকেলটা পুরাতন
হলেও তাকে
তিন হাজার
টাকা দেওয়া
লাগবে বলে
জানিয়েছে। প্রথম দিকে ভালোভাবে টাকা
চাইলেও এখন
সেই সাথে
কিছু কটু
কথা অনায়াসেই
চলে আসে।
সেটা আদম
গাজীকে মুখ
বুজেই সহ্য
করতে হয়।
সারা জীবনে
আদম গাজীকে
এ ধরনের
কথা হজম
করার মত
পরিস্থিতির শিকার হতে হয়নি। এসব
কথা শোনার
জন্য সে
এখন রশিদকে
একটু এড়িয়ে
চলা শুরু
করেছে। ইদানিং
রশিদ বাড়িতেও
আসা শুরু
করেছে। তাই
এখন বেশিক্ষণ
বাড়িতে থাকাও
সম্ভব হয়
না।
আজ মরিয়মের জন্য
কয়েকটা ওষুধ
কেনা দরকার।
ব্যাগটা হাতে
নিয়ে বাড়ি
থেকে বের
হওয়ার মুখেই
রশিদকে ঢুকতে
দেখা গেল।
রশিদকে দেখেই
আদম গাজী
চমকে ওঠে।
এই চমকে
উঠার ধাক্কাটা
একেবারে ছোট
নয়; বেশ
বড় রকমের।
রাগ মিশ্রিত
কণ্ঠে রশিদ
বলে উঠে-
"কী ব্যাপার!
সাহেব ব্যাটার
মোটে দেকাই
পাওয়া যায়
না। বার
বার আইসে
ফিরে যাচ্ছি।
আমার টাকা
দিসনে ক্যান?
টাকাগুলো কি
মাগনা? সোজা
আঙুলি ঘি
ওঠে না
তাই না?
বাজারে মেলা
মানষির সামনে
যখন গোলায়
গামছা দেবানে
তখন টাকা
দিতি গা
লাগবেনে। আমার
যেন সে
পন্তুক যাবা
লাগে না।
আমি এই
বাড়ি আর
আসতি পারবো
না। তিন
দিনির মদ্যি
যদি টাকা
না পাই
তালি তাই
করবো।" কথাটা বলে কোন উত্তরের
আশা না
করে রশিদ
মুখ ঘুরিয়ে
চলে গেল।
আদম গাজী থ
হয়ে দাঁড়িয়ে
রইল। কিভাবে
টাকা দেবে,
পুরোটাই যে
অনিশ্চিত। সঞ্চয় বলতে তো কিছুই
নেই উল্টো
দেনার অংক
বেড়ে যাওয়ায়
কেউ আর
টাকা দিতে
চাচ্ছে না।
চেয়ারম্যান সাহেব সাইকেল উদ্ধার করে
দেবেন এমন
লম্বা আশা
আর করা
যাচ্ছে না।
গত কালও
নাকি আরেকটা
সাইকেল চুরি
হয়েছে। চোর
ধরা পড়ার
কোনা সম্ভাবনা
নেই। রশিদ
যেভাবে অপমান
করে গেছে
তাতেও সাধ
মেটেনি। বাকীটুকু
জনসম্মুখে ধুলিসাৎ করে দিয়ে
গলায়.........। আর ভাবতে
পারে না
আদম গাজী।
গাল বেয়ে
অশ্রু ফোটা
গড়িয়ে এল।
কিছু একটা
করতেই হবে।
চোখ মুছে
মনটাকে শক্ত
করে এগুতে
থাকলো।
সর্বশেষ চুরি হওয়া
সাইকেলটির মালিক রফিক মিয়া সাইকেল
হারানোর পর
যখন শুনেছিল
পূর্বেও কয়েকটা
সাইকেল চুরি
হয়েছে তখনই
সে একটা
পরিকল্পনা করে সেই মোতাবেক কাজ
করার জন্য
আজ হাসপাতালে
হাজির হয়েছে।
পরিকল্পনাটি হল- ভালোমত একটা সাইকেল
ওখানে রেখে
আড়াল থেকে
তাতে নজর
রাখা হবে।
যদি কোন
ব্যক্তি সেটা
নিয়ে ভাগার
চেষ্টা করে
তখন ধরে
তাকে তুলোধনা
করা হবে,
আর পূর্বের
সাইকেলগুলোর দাম তো আদায় করে
নেওয়া হবেই।
সেই প্লান অনুযায়ী
একজন সাইকেল
চালিয়ে এসে
সেখানেই সাইকেল
রেখে সোজা
ভিতরে ঢুকে
গেল। লোকটা
একবারও পিছনে
তাকালো না।
ছাদের উপরে
যে আছে
শুধু সে-ই নজর
রেখেছে সাইকেলের
দিকে। গেটের
সামনে ভিড়ের
ভিতরে যে
দু'জন
আছে তাদের
অনুমতি নেই
এদিকে চেয়ে
থাকার। তাদের
কাজ উপরের
লোকটা যখন
হুকুম দেবে
তখনই প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা নেওয়া।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে
গেল সাইকেলের
পাশে কেউ
আসলো না।
রফিক মিয়া
মনে মনে
ভাবছে এ
পরিকল্পনায় বোধহয় কাজ হবে না।
হঠাৎ
একজন ভিড়ের
মধ্য থেকে
বেরিয়ে এসে
ভিতরে যাওয়া
মানুষটার পথের
দিকে তাকিয়ে
কি যেন
বুঝলো তারপর
সেই সাইকেলের
পাশে এল।
তালার দিকেই
নজর দিতেই
দেখলো তালা
খোলাই আছে।
লোকটা আশ-পাশ একটু
তাকালো। অগনিত
মানুষ যে
যার কাজে
ব্যস্ত। দ্রুত
সাইকেল ঠেলতে
শুরু করলো।
লোকটা ধারণা
করেছে কেউ
জানতে পারছে
না সাইকেলটা
তার মালিক
নিয়ে যাচ্ছে
নাকি অন্য
কেউ নিয়ে
যাচ্ছে। গেটের
একটু কাছাকাছি
আসতেই ছাদের
মানুষটার কণ্ঠে
ঘোষণা এল-
"ধর শালারে।"
সঙ্গে সঙ্গে
দু'তিন
জন ছুটে
আসলো লোকটার
দিকে। ছুটে
আসা লোকগুলোর
ভাবমূর্তি দেখে সে ব্যাপারটা বুঝতে
পেরেই সাইকেল
রেখে পিছন
দিকে ছুট
দিল। তারপর
কোলাহলরত অগনিত
মানুষের মাঝে
মিশে যাওয়ার
চেষ্টা চালালো।
কিন্তু বিধি
বাম। ভিড়ের
মাঝেও গোয়েন্দা
লাগানো ছিল
তা কে
জানে। খুব
শক্ত করে
কে যেন
এঁটে ধরলো
জামার কলারটা।
হ্যাঁচকা টানে
বের করে
আনলো ফাকা
জায়গায়। তারপর
সজোরে চোয়ালে
একটা কিল
বসিয়ে দিয়ে
উত্তম-মাধ্যমের
সূত্রপাতের গৌরব অর্জন করলো। সাথে
সাথে অন্যরাও
এসে অংশ
নিল সেই
কর্মে। কৌতূহলী
মানুষের মধ্য
হতে প্রশ্ন
এলো- "লোকটাকে মারা হচ্ছে কেন?"
উত্তরে বলা
হলো- "লোকটা সাইকেল চুরি করে
নিয়ে যাচ্ছিল।"
এ খবর
প্রকাশিত হওয়ার
পর বেশ
উত্তপ্ত ভাব
লক্ষ্য করা
গেল, নানা
গুঞ্জনও শোনা
গেল।
- “এখনো ব্যাটাকে আস্ত
রেখেছিস!”
- “ওর সাহসের তারিফ
করতে হয়।”
- “দেখি দেখি লোকটা
কেমন।”
- “এখনো মাথা উচু!
মার লাথি।”
অন্যের অপেক্ষায়
না থেকে
লোকটা নিজেই
লাথি মেরে
বসলো। কেউ
কেউ সরাসরি
এসেই দু'এক ঘা
বসিয়ে দিয়ে
হাতের ব্যায়ামটা
সেরে নিচ্ছেন।
গণধোলাইয়ে কোন প্রকার ব্যাকরণিক নিয়ম
মানার প্রয়োজন
হয় না
বলে চোর
মারার এই
মহান কাজে
সবাই শরীক
হচ্ছেন নিঃসঙ্কোচে।
ভিড়ের মধ্য
থেকে একজন
বলে উঠলো-
"আর মারিসনে।
এর কাছ
থেকে সব
কডা সাইকেল
বুঝে ন্যাবো,
চ্যারমেনের কাছে নে চল।" কথাটা
যুক্তিযুক্ত মনে করে অনেকে সায়
দিয়ে বলে
উঠলো- "তাই চল।" রফিক মিয়া
চোরের কলার
ধরে টেনে
তুলে জনতার
উদ্দেশ্যে বললো- "এই তোরা আয়
আমার সাতে।"
উঠানে মানুষের কোলাহল
শুনে ব্যাপারটা
জানার জন্য
চেয়ারম্যান সাহেব ঘর থেকে বের
হয়ে আসার
সাথে সাথেই
চোরটাকে ধাক্কা
দিয়ে ফেলে
দেওয়া হল
চেয়ারম্যান সাহেবের পায়ের গোড়ায়। তারপর
যে যার
মত বলা
শুরু করলো।
বিভিন্ন মুখ
থেকে অল্প
অল্প শুনতে
শুনতে তিনি
মুল বিষয়
সম্পর্কে মোটামুটি
অবগত হলেন।
তারপর বিরক্তি
মিশ্রিত চোখে
একবার তাকালেন
উপুড় হয়ে
থাকা চোরটার
দিকে। কিছু
একটা বলতে
গিয়েও বললেন
না। চোরকে
প্রথম ধাপের
পাওনাটা মিটিয়ে
দেওয়ার জন্য
হাত গোটালেন।
অনেক দিন
ধরে চোর-চোট্টা হাতের
কাছে পাওয়া
যায় না
বলে জনগণের
কাছ থেকে
বাহবা পাওয়া
যাচ্ছে না।
নিচু হয়ে
চোরের চুলের
মুঠি ধরে
টেনে তুললেন।
কিন্তু মুখের
দিকে তাকিয়েই
তিনি বিজলির
মত চমকে
উঠলেন। "কী ব্যাপার আদম তুমি!"
কথাটা শুনে
ভ্যাক করে
কেঁদে ফেললো
চোরটা। রক্তাক্ত
মুখখানা বড্ড
করুন হয়ে
গেল। অতি
অসহায়ের মত
কেঁদে বললো-
"রশিদির কটু কতা আমি আর
সহ্য কত্তি
পাত্তিছিলাম না চ্যারমেন সাব। তাই
মনে করলাম
যেভাবে আমি
ওর সাইকেলটা
হারাইছি সেভাবে
একটা নিয়ে
বিক্রি করে
ওর টাকাটা.......।" কথাটা শেষ না
করে ডুকরে
কেঁদে উঠলো।
চেয়ারম্যান সাহেব বুঝতে পারছিলেন না
কী করবেন।
চোখের পানিতে
মুখের রক্ত
ধুয়ে ধুয়ে
পড়ছে। তিনি
আদমের মুখের
দিকে তাকিয়ে
যেন স্পষ্ট
দেখতে পাচ্ছিলেন
এ কান্না
শারীরিক প্রহারের
নয়; দীনতার
কশাঘাতের।
###
(২০০৫ সালে সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত)