যোগ্য

জাকির হোসেনের যখন মন খারাপ হয় তখন সে তার ক্রেস্টগুলোর দিকে তাকায় না। তাকালে খুব রাগ হয়। ওগুলো মূল্যহীন মনে হয়, ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে।

অনেক দিন যাবত ঘরের এ দিকটায় নজর পড়ে না। দেয়ালে টানানো নতুন ছবিটা দেখতে গিয়েই ওগুলো নজরে এল। দেয়ালে সুন্দর একটা ছবি টানানো হয়েছে। নদীতে একটা পাল তোলা নৌকা আর নদীর চর জুড়ে সারি সারি কাশফুল। সাবিনারই কাজ এটা। তার স্ত্রী সাবিনার নদী খুব প্রিয় তা সে অনেক আগে থেকেই জানে।

সাবিনা অনেকবারই তার কাছে আবদার করেছে নদী পথে ঘুরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে একবারও নিয়ে যায়নি। কেন যেন তার এসব আর ভালোলাগে না। ভালো না লাগার কারণও তাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। যার কি না শৈশব কৈশোরের প্রায় সমস্ত সময়টা কেটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। সেই উচ্ছল উদ্দীপনাময় দাপাদাপির কথা সে কখনো ভুলে যায়নি। তবে মাঝে মাঝে ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।

সাবিনা সম্ভবত চা করতে গেছে। ফিরে এসে তাকে এভাবে ছবির দিকে চেয়ে থাকতে দেখলে প্রসঙ্গ পেয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথাটা আরো একবার পেশ করতে পারে। তাই সে জায়গাটা ত্যাগ করার প্রয়োজন মনে করে নজরটা নামিয়ে সরে পড়তে চাইলো।

সর্বশেষ নদী ঘুরে আসা হয়েছে প্রায় পনের থেকে ষোল বছর আগে। এর মধ্যে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেলেও সেই কথাটা সে ভুলে যায়নি। সেদিন তার এক চাচাত বোনের বাড়িতে যেতে বেশ কিছু পথ নদীপথে যেতে হয়। একটা বিশেষ কারণে তাকে ওখানে যেতে হচ্ছিল। ইঞ্জিনচালিত নৌকা। ট্রলার নামেই এলাকার মানুষ চেনে। ট্রলার এগিয়ে চলছে নদীর বুক চিরে। সামনের দৃশ্য দেখার পাশাপাশি মাঝে মাঝে নজর চলে যাচ্ছে তার থেকে কয়েকটা মানুষের পরে বসে থাকা এক মহিলার কোলে ছোট্ট ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে। কিছুক্ষণ পর পর সে ছোট্ট ছোট্ট শব্দ করে তার চঞ্চলতার আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ট্রলারের সম্মুখভাগের বেশির ভাগ অংশ খোলা অবস্থায় থাকায় নদীর মনোরম দৃশ্যাবলী মনটাকে দোলায়িত করে তুলছে। এর মাঝে হঠাৎ ঝপাৎ করে একটা শব্দ কানে এল। তার পর পরই হাউমাউ করে মেয়েলী কণ্ঠের কান্না শোনা গেল। চোখ ফেরাতেই দেখা গেল সেই বাচ্চা মেয়েটির মায়ের কান্না, আর ঐ ফুটফুটে বাচ্চাটি তার মায়ের কোলে নেই। ঐ শব্দটি যে তারই নদীতে পড়ে যাওয়ার শব্দ তা বুঝতে বাকী রইল না। এতে আশপাশের মানুষগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগী মানসিকতা না দেখে নিজেই লাফিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাকির হোসেন। পানিতে চলার সুবিধার্থে পায়ের জুতো জোড়া দ্রুত চাপ দিয়ে খুলে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। মহিলার কান্নাজড়িত নিষেধে ট্রলারের ইঞ্জিনও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এদিকে জাকির হোসেন তার দু’হাত দ্রুত সঞ্চালন করছে আর নজর দিচ্ছে কোথায় পানি নড়ে ওঠে। তার পরনে দামি শার্ট-প্যান্ট নদীর ঘোলা ময়লা পানিতে নষ্ট তো হচ্ছেই তার উপর পানি আটকে গিয়ে চলতে সমস্যা হচ্ছে। তবে পোশাকটা যতই দামী হোক নিশ্চয় ও বাচ্চাটার জীবনের চেয়ে বেশি দামী নয়, এ কথা ভেবেই আর খোলা হয়নি।

হাতের কাছে সামান্য একটু স্পর্শ পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত দিয়ে ধরে উঁচু করে তোলে। তারপর আস্তে নৌকার কিনারে এসে দু’হাত বাড়িয়ে থাকা মহিলার কাছে সমর্পন করে। তখন মহিলার চোখে-মুখে প্রাপ্তির ছটা। মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার বিচ্ছুরিত চাহনি এখন তারই দিকে। মায়ের প্রাপ্তির রেশ আর জনতার চাহনি জাকির হোসেনকে বিজয়ের বীর করে তুলেছে। বিজয়ের ভালোলাগা অনেকবারই এসেছে। সাঁতার প্রতিযোগিতায় কত জায়গায় কতবার যে প্রথম হয়েছে তার হিসেব নেই। তাছাড়া পানিতে বিশ-পঁচিশ জনের মধ্য থেকে হাঁস ধরার রেকর্ড তার কম নয়। তার সাঁতারের সুনাম শুধু তার এলাকাতেই নয়, দূর-দুরান্ত বড় বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ছিনিয়ে এনেছে দামী দামী পুরস্কার ও ক্রেস্ট। এগুলো হাজারো মানুষের সামনে তার সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব উপহার এখনো সাজানো রয়েছে তার তাকের উপর। বাচ্চা মেয়েটিকে তুলে আনার পর তার ঐ স্বীকৃতির মর্যাদা যেন আরো বেড়ে গেল। কর্তৃপক্ষ যে যোগ্য ব্যক্তিকেই পুরস্কৃত করেছিল তা সে প্রমাণ করে দেখিয়েছে।

ঘটনাটা গত হয়েছে প্রায় পনের ষোল বছর। এত দিনে মেয়েটিও অনেক বড় হয়ে গেছে। আজ তার কথা মনে হতেই মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। বলতে না বলতেই হঠাৎ কোথা থেকে সে দৌড়ে রুমের মধ্যে ঢুকে সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট। বেশ হাসি খুশি মুখ। প্যাকেট খুলে মিষ্টি বের করে জাকির হোসেনকে হা করতে বলল। জাকির হোসেন বুঝতে পেরেছে কিছু একটা খুশির ব্যাপার হয়েছে এবং তা এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশন হবে। এতটুকু আঁচ করতে পেরে মনে মনে উদগ্রীব হলো। মিষ্টিটা গালে দিয়েই ও বললো- "মামা, জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমি ও আমার টিম বিজয়ী হয়েছি”। কথাটা শুনে জাকির হোসেনের মনটা আনন্দে ভরে গেল। ও আরো জানালো আজ একটু পরেই ঐ অনুষ্ঠানটি টিভিতে দেখাবে। কথাটা শুনে জাকির হোসেন যেন আনন্দের মধ্যে ডুবে গেল। দ্রুত উঠে গিয়ে টিভিটা অন করলো।

সাবিনা কাপ হাতে রুমের মধ্যে ঢুকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। যে মানুষ ঘুমাবে বলে ডিস্টার্ব করতে নিষেধ করলো আবার এখন টিভি অন করে বসে আছে, ব্যাপার কী! সাবিনা এগিয়ে এসে বললো- "এখন ঘুমাবে না?" সাবিনার কথা শুনে চমকে উঠলো জাকির হোসেন। যেন একটা অস্বাভাবিকতা ঘিরে ধরলো তাকে। এই সুযোগে মেয়েটিও কোথায় যেন চলে গেল। সে আশে পাশে তাকিয়ে মেয়েটিকে খুঁজতে লাগলো। স্বামীর চেহারায় উদ্বিগ্নতা দেখে সাবিনা কি হয়েছে জানতে চাইলো। কিন্তু জাকির হোসেন কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ এদিকে ওদিক তাকিয়ে আর তাকালো না। সে জানে মেয়েটিকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ সেদিন নদীতে পড়ে যাওয়া সেই বাচ্চাটিকে সে তুলে আনেনি। কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী করা অভাগী মায়ের কোলে তার সন্তানটিকে সে ফিরিয়ে এনে দেয়নি। অনেকের মত নিজেও কিসের মায়ায় যেন নিজের জায়গাতেই বসেছিল। এসব কথা সাবিনাকে কী করে বলবে? তার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল।

এখন তার মন খারাপ। সে এখন ক্রেস্টগুলোর দিকে তাকাবে না। তাকালে খুব রাগ হবে। ওগুলো মূল্যহীন মনে হবে, ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করবে।

# # #