প্রাণহীন রাজ্য

আজ আমাদের চোখের সামনে যে অঞ্চলটা অত্যন্ত অবহেলিত; বর্তমানে যার সাজসজ্জা সামান্য কূড়ে আর অনুন্নত সরু মেঠো পথ, সেটাই যে একদিন এতদাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ স্থান ছিল এমনকি এখানেই একটা রাজ্যের অধিপত্য ছিল তা অনেকেই আজ মানতে নারাজ বা অনেকেরই বিশ্বাসের বাইরে। আজ যে জায়গাটা সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার ধুমঘাট নামক একটা গ্রাম হয়ে পরিচিত একদিন এটাই যে ইতিহাসের সেই যশোর রাজ্যের রাজধানী ছিল তা সবার বিশ্বাসযোগ্য নয়। আজ যারা জীবিত তাঁরা কেউ ধুমঘাটকে রাজধানী রূপে দেখেনি, শুনেছে শুধু এখানে একসময় রাজধানী গড়ে উঠেছিল।

এ স্থান সম্পর্কে জানার কৌতুহল একটু বেশি থাকলেও তা পুরোপুরিভাবে পরিতৃপ্ত হওয়া যায় না। কারণ ইতিহাসের বিচ্যুত কলাম থেকে একটু আধটু যা জানা যায় সেটুকুতেই এর পরিসীমা বাঁধা। বর্তমানে এখানে এমন কোনো ভবন বা পুরাকীর্তি নেই যা দ্বারা প্রমাণিত হবে যে এটা এক সময়কার জৌলুসভরা প্রখ্যাত কোনো এলাকা ছিল। যারা এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী তাঁদের কেউ বেঁচে নেই। সময়ের ঝাপটায় অনেকখানি দূরে সরে গেছে সবাই। আগের সেই রাজ্য নেই; রাজা নেই; নেই ধুমধামের রাজধানী সেই ধুমঘাট। আজ আছে শুধু ধুমঘাট নামের একটা অবহেলিত নিভৃত পল্লী। ভাবতে অবাক লাগে কীভাবে এমন আমূল পরিবর্তন সম্ভব! একসময় বাসস্থান সূত্রে যে জায়গাটা ছিলো গর্বের বিষয় আজ একই সূত্রে সেটা হয়েছে বড় কটাক্ষের বিষয়। শুধু কটাক্ষতেই ক্ষান্ত নয়; এ অঞ্চলের মানুষদের বোধশক্তির ঘাটতি আছে বলে চিহ্নিত করা হয়। এমনকি অন্য কোনো ব্যক্তিকে বোধহীনতায় ভূষিত করতে এ অঞ্চলের জনতাকে মডেল হিসেবে ব্যবহার কর হয়। এমনিভাবে এ অঞ্চলটা অবমতে অভিভূত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে এর জনতার মনে সাময়িক একটু অভিরোষ জন্ম নিলেও তাতে করার কিছু নেই। পৌরুষ হারিয়ে জৌলুস খোয়ায়ে এ অঞ্চলটা আজ বিদ্রুপের শিকার। বর্তমান সভ্যতায় এই অবস্থানের প্রেক্ষিতে হয়তো সে নীরবে কাঁদছে অগোচরে। এ পরিণতির একটা কারণ হিসেবে ধরা যায় তার ঐতিহ্য নিদর্শনের বিচ্ছেদ। বর্তমানে দেখা যায় তার সেই ঐতিহ্যের ধারক আজ বিভক্ত হয়ে গেছে পার্শ্ববর্তী গ্রামে। এতে তাঁর স্বীয় নিদর্শন দূরে সরে গেছে। এই বিচ্ছেদই তাঁর বিদ্রুপতায় যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে এখানে প্রতাপের সেই আধিক্যতার বিন্দুমাত্র প্রভাবও অব্যাহত নেই, নেই কোনো শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ। এসব আনুষঙ্গিক প্রমাণগুলো আস্তে আস্তে বিলীন, বিলুপ্ত ও বিভক্ত হওয়ায় বর্তমানের উদীয়মান জনতার মনে কিঞ্চিৎ সংশয় বাসা বেঁধেছে। যার কারণে সত্য ব্যাপারটা তাঁদের কাছে উপেক্ষার সম্মুখীন। অথচ এটাই সত্য যে, এই সেই অঞ্চল যেখানে এক আধিক্য অধিপতির বিস্তৃত অধিপত্য ছিলো। বর্তমানে এখানে তার কর্তৃত্বের চিহ্ন না থাকলেও তাঁর অনবদ্য সাক্ষী হয়ে আজও বিরাজমান সুবিন্যাস্ত নভস্থল, বহমান বায়ুধারা। আজও এই আকাশ-বাতাসে মিশে আছে প্রতাপাদিত্যের সেই বজ্রমুখর হুঙ্কার। মিশে আছে তাঁর প্রজার হাসি-কান্না, দুঃখ-সুখের সুরধ্বণি।

ষোল শতকের একটু আগে ইতিহাসের উজ্জ্বল চরিত্র সেই প্রতাপাদিত্য এখানেই তার যশোর রাজ্যের রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন। এটাই হলো সেই জায়গা, যেখানে নৌ-বাহিনী, পদাতিক বাহিনী, ঢাল-লাঠিয়াল বাহিনীর পদচারণায় সারাক্ষণ গমগম করতো।

প্রতাপ ছিলেন একটু নিষ্ঠুর প্রকৃতির, তবে তাঁর এ নিষ্ঠুরতার প্রভাব প্রজাদের উপর খুব বেশি পড়তো না। যারা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো তারাই হতো প্রতাপের নিষ্ঠুতার শিকার। যখন তিনি যশোর রাজ্যের অধিপতি হন তখনও তিনি নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটিয়ে একটা বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন, যা শুনলে হৃদয় শিউরে ওঠে। ক্ষমতার নেশা মানুষকে জঘন্য করে দেয়। বসন্ত রায় নামে যশোর রাজ্যের অন্য একজন অংশীদার ছিলেন। প্রতাপ একাই এ রাজ্যের অধিপতি হওয়ার জন্য শুধু ঐ বসন্ত রায়কে নয়, বসন্ত রায়ের পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করেছিলেন। এই হত্যাকান্ডের পরেই তিনি একমাত্র অধিপতি হয়ে ধুমঘাটে রাজধানী গড়ে তোলেন। তখন থেকেই ধুমধাট হয়ে ওঠে ধুমধামে পরিপূর্ণ মনোমুগ্ধকর একটি অঞ্চল। বেশ ভালো করেই সাজিয়েছিলেন ধুমঘাটকে। নিজের ইচ্ছেমত সব ধরনের লোক নিয়োগ, বাতিল করতেন। পছন্দমতই বাহিনী তৈরি করেছিলেন। মনে মনে তিনি মোঘল শক্তিকে দমাবার জন্য বিভিন্ন প্রকার শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। নৌবাহিনী, পতাদিক বাহিনী, লাঠিয়াল বাহিনী ছাড়াও প্রতাপের কামানবাহী নৌকা ছিল। এছাড়াও হস্তি ও অশ্বারোহী বহু সৈন্য ছিল তার। এসব গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মোঘলদের প্রতিহত করতে হবে এবং তার প্রিয় ধুমঘাটকে আরও জাগিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু প্রতাপের ভালোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করার আগেই এসব কথা মোঘল সম্রাটের কানে গেল। তিনি ব্যাপারটা তদন্ত করতে এবং প্রতাপের লোলুপ আকাঙ্ক্ষা নাশ করতে দু'শ্রেণীর বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেন। এদিকে মোঘল সৈন্যের আগমনী সংবাদ শুনে প্রতাপের বাহিনী তাৎক্ষণিক প্রস্তুতি নেয়। রাজ্যের মধ্যে প্রবেশলগ্নেই দু'দলের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। চলতেই থাকে সে যুদ্ধ। প্রতাপ তার সমস্ত বল প্রযোগ করেও কোনো সাফল্যের মুখ দেখতে পারলেন না। একের পর এক তাঁর সমস্ত দুর্গ মোঘল সৈন্যের দখলে চলে গেল। শেষ দুর্গটা হারাবার আগেই প্রতাপ পরিবারের সাথে পরামর্শ করে তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরের দিন যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতাপকে দিল্লী পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু প্রতাপ মোঘলদের কাছে ছোট হওয়ার বা অপদস্ত হওয়ার আশঙ্কায় যাত্রাপথেই আত্মহত্যা করেন।

এখানেই ইতি ঘটে অবিস্মৃত একটি পরিচ্ছেদের। এ মৃত্যু প্রতাপের একার মৃত্যু নয়; তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ধুমঘাটেরও মৃত্যু হয়েছিল। শুধু এর পচনশীল ক্ষমতা নেই বলে আজও আমাদের চোখের সামনে প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে আছে। আর কোনোদিন হয়তো পূর্বের মত প্রাণবন্ত হতে পারবে না। পারবে না আগের মত অমন চটকী হতে। শুধু গল্প হয়েই থেকে যাবে বছর থেকে বছর, যুগ থেকে যুগান্তরে।


# # #