বারণ

যে কয়টা কারণে রাকিবের মেজাজ প্রচন্ড রকমের খারাপ হয় তার একটা কারণ ইতোমধ্যে ঘটে গেছে বিধায় এখন তার রাগ চরমে ওঠা স্বাভাবিক। সে জন্য এখন তার রাগের মাত্রা মিটার স্কেলের উপরিভাগে ভাবমান। ইচ্ছে হচ্ছে সহাপাঠীদের উপর চরম আকারের একটা মেজাজ দেখিয়ে সবকিছু ছুড়ে ফেলে চলে যেতে।

আজ ছুটির দিন থাকায় গতকালই ৪ জন বন্ধু মিলে ঠিক করা হয় একটা নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের নদী-নালায় ঘুরে বেড়াবে আর মজা করবে। সেই প্লান অনুযায়ী আজ ৪ জনই এখানে হাজির। রাকিব, রনি, সুমন ও শামীম। অষ্টম শ্রেনীর রোল তালিকার মধ্যভাগের ৪টি নাম। সপ্তম শ্রেনীতে থাকাকালীন রাকিবের নামটা রোল তালিকার প্রথমাংশে থাকলেও দস্যিপনা ও বাদরামীর মিশ্রিত প্রভাব সে নামটাকে নিয়ে গেছে রোল তালিকার মধ্যভাগে। বর্তমানেও সেই নীতি বহাল থাকলে নামটা যে তালিকার শেষাংশে আশ্রয় নিবে তা নিয়ে নির্ণয় করতে কোনো জ্যোতিসির সংস্পর্শে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।

সকালে রাকিব বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলে এসেছে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট দেখতে যাচ্ছে। নৌকায় সুন্দরবন ঘোরার কথা শুনলে তিনি কোনোভাবেই আসতে দিতেন না। তারপরও যে নিষেধ করেননি তা নয়। খেলা দেখতে গিয়ে অতিরিক্ত রোদে শরীর খারাপের কথা বলে না আসতে নিষেধ করায় মাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ছায়ার ব্যবস্থার কথা বলে মায়ের সে আশঙ্কাকে দূরীভূত করা হয়েছে।

গতকাল রনিকে একটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। জমির শেখের নৌকাটা মজবুত ও সুন্দর তাই তার কাছে একটু বিনয় দেখিয়ে নৌকার চাবিটা নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু সে বিকালে না গিয়ে আজ সকালে যাওয়ার কথা চিন্তা করে। আজ সকালে তার বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর কাছে জানা যায় জমির শেখ কোথায় যেন চলে গেছে। এ কথা শোনার পর চাবি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই জেনেও আবেদনটা পেশ করা হলে তার স্ত্রী জানায় স্বামীর অনুমতি ছাড়া চাবি কারো কাছে দেওয়া নিষেধ আছে। এ কথার পরে আর কোনো আপিল করা চলে না। তাই আর আপিল করা হয়নি। বিমুখ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। গতকাল না যাওয়াটা যে কত বড় ভুল ছিল সেটা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। এখন একমাত্র উপায় করিম আলীর ভাঙ্গা-চোরা মার্কা নৌকা, যা চুরি হওয়ার ভয় নেই বলে কোনো সময় তালা লাগানোর প্রয়োজন হয় না।

সকালে জায়গামত হাজির সকলেই। রনি বুঝিয়ে সুজিয়ে শামীম ও সুমনকে সংযত করতে পারলেও রাকিবের রাগ আর থামে না। কেউ থামাতেও পারছে না। এ ধরনের ঘটনায় তার প্রচন্ড রাগ হয়। ভাঙ্গাচোরা এ নৌকাটা তার মোটেও পছন্দ না। এ নৌকা নিয়ে গেলে কোনো মজাই হবে না। গতকাল জমির শেখের কাছে গেলে এমনটা হত না। রাগ দেখিয়ে সবকিছু ফেলে চলে যেতে ইচ্ছে করছে রাকিবের। কিন্তু এভাবে চলে যাওয়া কি ঠিক হবে? নৌকা নিয়ে অন্যদের তেমন কোনো অসন্তুষ্টি নেই। রাকিব না গেলেও এরা ঠিকই ঘুরতে চলে যাবে। তারপর আগামীকাল যখন নিজেদের মধ্যে সেই গল্প করবে আর মজা করবে তখন কি খারাপ লাগবে না? অবশ্য উপায় একটা আছে, এখন রাগ দেখিয়ে চলে যাওয়ার ভান করলে ওরা মান ভাঙ্গিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনবে। তাতে করে নিজের ভাবও বজায় থাকলো কাজও হাসিল হলো। তবে একটা কথা আছে, ওরা যদি মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা না করে তবে তো নিজের ইচ্ছায় আবার এখানে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। তাহলে প্রেষ্টিজ থাকবে না। সুতরাং অভিমানের ভান করে এমন রিস্ক নেওয়াটা কি ঠিক হবে? তার চেয়ে হয়তো ভালো হয় একটা অসন্তুষ্টিমূলক ভাব নিয়ে থাকি, তাহলে ওদের কাছ থেকে একটা তোষামোদী ব্যবহার পাওয়া যাবে। আর সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তাদের উপর ওস্তাদগিরি ভাব নেওয়া যাবে। রনি রাকিবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, কী চিন্তা করছিস? চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাকিব আর আপত্তি জানালো না, নৌকায় উঠে গেল।

জোয়ারে নদী ফুলে আছে। নৌকা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে কেউড়া, বাইনের পাতা ঘেষে। মাঝে মাঝে নদীতে শুয়ে পড়া গাছের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে নৌকা। একটা বাইন গাছের নিচের অংশের অনেকটাই পানিতে ডুবে আছে। ডালা-পালা পানি বরাবর। নৌকাটা এখন তার ভিতরেই। এখন দস্যিপনায় মত্ত ৪ কিশোর। রাকিব লাফাতে লাফাতে গাছের উপরের ডালে উঠে দোলা দিচ্ছে। রনির মাথায় দুষ্টমি ভর করলো। সে গাছটা ধরে ঠেলা দিয়ে ৩ জনসহ নৌকা নিয়ে দূরে সরে আসলো। হাসতে হাসতে বলল, “রাকিব তুই এখানে থাক আমরা ঘুরে আসি”। সুমন ও শামীমও সেই সাথে হো হো করে হেসে উঠলো। রাকিবের মনে ভয় ঢুকে গেল। ওরা সত্যি যদি চলে যায় তাহলে একা একা এই গভীর বনের পাশে....। মনটা দোল দিয়ে উঠলো ওর। তবে মুখের ভাবখানা তা নয়। "যা, তোরা যা, কোনো সমস্যা নেই। আমি তোদের মত ভিতু না। এখান থেকে বাড়ি যাওয়া আমার জন্য কোনো ব্যাপার না।" ভয় ভয় করলেও এতটুকু ভরসা আছে যে, ওরা তাকে ফেলে চলে যাবে না। রনি আবার আস্তে আস্তে নৌকাটা আবার কাছে ভিড়ালো। রাকিবের ভাব আরো বেড়ে গেল। নৌকায় লাফিয়ে পড়ে বললো, "আসলি কেন আবার, এতটুকু নদী সাঁতার দিয়ে পার হওয়া আমার জন্য কোনো ব্যাপার?" শামীম ফোড়ন কেটে বললো, "উহ্‌, কী বীর পুরুষ আমার জানা আছে। দেখলাম তো সাঁতার দিয়ে কত নদী পার হলে"। এ কথায় শামীম রাকিবকে একটু দমানোর চেষ্টা করলেও রাকিব তা গায়ে না লাগার চেষ্টা চালালো।

নৌকা আবারো হেলে দুলে সামনে এগুচ্ছে। পাশ দিয়ে একটা সরু খাল বনের ভিতরে ঢুকে গেছে। রাকিব সেটাকে ইশারা করে বললো, "বনের ভিতরে যাবি নাকি? তোদের তো আবার বুক দুরু করে"। সবুজ বললো, "বেশ তো চল"। রনিও সমর্থন দিয়ে বললো, "চল যাই"। রাকিব অবাক! এখন এটাকে না করা যায় কী করে? ততক্ষণে শামীম নৌকা খালের ভিতরে ঢুকানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এত সহজে এরা বনের ভিতরে যেতে রাজি হবে তা কে জানতো!

খালের মধ্যে ঢুকে পড়ার পর সূর্যের আলো একটু কম পাওয়া গেল। দু'পাশে গাছ আর গাছ। নৌকা যত ভিতরে যাচ্ছে তত রাকিবের গা ছম ছম করছে। ডান পাশে হেতালি গাছের সারি। সুন্দরবনের হেতালি বাগানের এলাকাতেই বাঘের আনাগোনা বেশি থাকে। আস্তে আস্তে রাকিবের কণ্ঠ যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। রাকিব সেটাকে ওদের বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ডান পাশ থেকে কচ কচ একটা শব্দ কানে এলো। সঙ্গে সঙ্গে রাকিব আতকে উঠলো। সে শব্দতে অন্যদের কোনো মানসিক পরিবর্তন দেখা গেল না। তারা কথা বলছে আর নৌকা বেয়ে চলেছে। শামীম রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললো, "কীরে রাকিব মুখে কোনো কথা নেই কেন? ভয় টয় করে নাকি?" কথাটা শুনে রাকিব থমকে গেল, তবে সেটাকে আড়াল করার জন্য একটি হাসি দেয়ার চেষ্টা করলো, যদিও হাসিটা কৃত্রিম। সে হাসির রেশটা থাকতে থাকতে খালের কিনারের দিকে তাকিয়ে বললো, "জোয়ারের পানি থাকাকালীন বাঘ কিনারায় একটু কম আসে। এখন কিন্তু পানি নেমে যাচ্ছে। তাছাড়া তোদেরকে আমিই বলে এর ভিতরে ঢুকালাম। যদি একটা কিছু হয়ে যায় তখন কিন্তু আমার উপর চাপ দিতে পারবি না। চিন্তা করে দেখ আর সামনে যাবি কি না"। কথাটা যেন সুমনের কাছে যথাযথ মনে হলো। সে বললো, "আমার মনে হয় আর সামনে যাওয়া ঠিক হবে না"। শামীমও বললো, "ঠিক আছে, তবে ফিরে চল"।

নৌকা পেছন দিকে নেয়া হচ্ছে। রাকিবের মনটা দেহে ফিরে আসছে। বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। তবে বড় নদীতে না যাওয়া পর্যন্ত শঙ্কাটা মন থেকে যাচ্ছে না। ওরা এখনো জানে না রাকিবের মনের অবস্থা কী। বুকে হাত দিলেই বোঝা যাবে হৃৎপিন্ডটা কী বেগে লাফাচ্ছে। অথচ ওদের মনে কোনো ভয় নেই। এতেই রাকিব বুঝে ফেলেছে ওদের তুলনায় রাকিব কতটা ভীতু। কিন্তু সে খবর ওদের বুঝতে দেয়া যাবে না, নইলে ওরা দুর্বল পয়েন্ট পেয়ে যাবে। নৌকাটা বড় নদীতে এসে গেছে। রাকিব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

পরের দিন সকাল। ওপাশের ঘর থেকে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো রাকিবের। রাকিব উঠতে গিয়েও আবার শুয়ে পড়লো। শরীরটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হলো। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। কপালে হাত রাখতেই শিউরে উঠলো রাকিব। প্রচন্ড তাপ অনুভব হলো। আম্মুকে বললো, "আম্মু দেখ তো আমার শরীর এত গরম কেন? আম্মু ছুটে এসে গায়ে হাত রেখেই বললেন "এ কী! জ্বরে তো শরীর পুড়ে যাচ্ছে"। এরই মধ্যে রাকিবের ছোট চাচা ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। তিনি ঘরে ঢুকেই রাকিবের আম্মুর অস্থিরতা আর রাকিবের মুখখানা দেখেই ব্যাপারটা সম্পর্কে মোটামুটি অবগত হলেন। রাকিবের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "এমন হঠাৎ জ্বর! ভয় টয় পেয়েছিলি নাকি? ভয় পেলেও এমন জ্বর হয়”। "ভয় পাবো কোথায়? ভয় পেলে তো আম্মুকে জানাতাম”। কথাটা শেষ করার পর রাকিব মনে করার চেষ্টা করলো আসলেই সে ভয় পেয়েছিল কি না। হঠাৎ মনের পর্দায় ভেসে উঠলো গতকাল বনের ভিতরের সেই মুহূর্তের কথা। আসলেই তো সে ভয় পেয়েছিল। বেশ বড় রকমের ভয়। এ কথা মা জানলেই বিপদ।

উঠানে কে যেন রাকিবকে ডাকছে। রাকিব কান পাততেই বুঝলো শামীমের কণ্ঠ। রাকিব তাকে ভিতরে আসতে বললো। রাকিবের আম্মু অন্য ঘরে ছিলেন। শামীমকে দেখেই তিনি বললেন- "শামীম, এদিকে এসো তো"। শামীম সেই ঘরের দিকে গেল। শামীম রাকিবের আম্মুর সাথে কথা বলছে। রাকিব মাথা উঁচু করে দেখলো শামীমের কাছে তার আম্মু কি যেন জিজ্ঞেস করছে। রাকিবের মনে চিন্তা বাসা বাঁধলো। গতকাল কোথায় গিয়েছিলাম, কি করেছিলাম সে কথা শামীমের কাছে শুনছে কি না কে জানে। বনে ঘুরতে যাওয়ার কথা আম্মুকে জানানো যাবে না সে কথা শামীমকে বলে দেয়া হয়নি। তাছাড়া শামীমও যদি জেনে যায় ভয় পেয়ে তার জ্বর হয়েছে তাহলে প্রেষ্টিজ পাংচার। ওরাও ভীতু বলে ক্ষ্যাপাবে। সর্বনাশ! আল্লাই জানে ওখানে কি আলাপ হচ্ছে। রাকিবের স্মৃতিশক্তিতে যে কয়টা দোয়া-কালাম মুখস্ত করা ছিল সেগুলো এখন কাজে লাগানো হচ্ছে। এতেই যদি সুযোগ মেলে। তাছাড়া আপাতত কোনো পথ খোলা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে আম্মু ও শামীম এ ঘরে আসবে তখন কি যে পরিস্থিতি হবে তার আগাম পরিকল্পনা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। রাকিবের টেনশন আরো বেড়ে যাচ্ছে। দোয়া কালামও ভুল হয়ে যাচ্ছে। মায়ের বারণ উপেপেক্ষা করে বেড়াতে যাওয়ার ফলাফল এমন হবে কে জানতো! এখন মায়ের বকুনি, পিটুনি সেই সাথে বাড়তি বোনাস হিসেবে পাওয়া যেতে পারে বন্ধুদের টিটকারী। আম্মু এদিকে আসছে, পেছনে শামীম। দোয়া কালামই এখন ভরসা। সেই সময় আরো কয়েকটা দোয়া কালাম শিখে রাখা ভালো ছিল।
# # #