নুরু

করিম চাচার কাছে পড়তে যাই বলে প্রতিদিনই যে যেতে হবে তার তো কোনো মানে নেই। যাব না আজ। নুরু এ সিদ্ধান্তই ফাইনাল করে নিল। পড়তে আর তেমন ভাল্লাগে না। অভাবের মাঝে পড়াশুনা হয় নাকি? পরিবারের এ অবস্থার জন্য মাকেও দোষ দেয়া যায় না। সে একাই তিনটা ছেলে-মেয়ের আহার যোগাচ্ছে। আব্বা মারা গেছে তো আর আজ নয়; বেশ আগে। তিনি বেঁচে থাকলে কি সংসারে এমন অভাব থাকতো? নিশ্চয় না। তাছাড়া পর পর চারটা সন্তান মারা যাওয়ার পর নুরুর জন্ম। পিতা নুরুকে কষ্ট দিতেই পারে না। পিতাকে নিয়ে বেশি কিছু ভাবে না নুরু। তাতে তার মনটা বেদনায় জর্জরিত হয়ে যায়। মাঝে মাঝে অশ্রু এসেও উকি মারে। থাক। তাকে নিয়ে না হয় না ভাবলো কিন্তু পড়াশুনা? এভাবে তো পড়াশুনা চলে না। চালোনোই বা কী দরকার? পঞ্চম শ্রেণী পাশ হয়ে গেছে। গরীবের ছেলের জন্য এর চেয়ে বেশি দরকার আছে নাকি? গার্ড সাহেব একটা কাজ দেবেন বলেছিলেন। বেতনও খারাপ না। তবে কি গার্ড সাহেবের কথায় রাজি হবে? রাজি হলে মন্দ হয় না। সেখান থেকে কিছু টাকা পেলে সেটা সংসারে দিতে পারলে অন্তত মায়ের কষ্টটা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা যাবে। অবশ্য মা জানলে যেতে দিতে চাইবে না। তাতে কি? সে তো আর বেঁধে রাখছে না। তবে আর চিন্তা কী? এখন কাজ গার্ড সাহেবের সাথে দেখা করা। যেই ভাবা সেই কাজ। নুরু রওনা হল গার্ড সাহেবের উদ্দেশে।

তিনি তো স্টেশনেই থাকেন। এদিক সেদিক খোঁজারও প্রয়োজন মনে হল না। সেদিকেই হাঁটতে থাকে নুরু। স্টেশনের কাছাকাছি যেতেই কানে এল- "এই ছেলে, এদিকে এস"। নুরু চোখ উঠিয়ে খুঁজতে থাকে কথাটার উৎপত্তিস্থল। পেয়েও গেল। এ তো গার্ড সাহেবেরও কণ্ঠ। তিনি যে না ডাকলেও নুরু তার কাছে যেত তা হয়তো তিনি বুঝতে পারেননি। নুরু বুঝতেও দিল না। তার কাছে গেল। লোকটা নুরুকে ট্রেনের কামরায় নিয়ে বসালেন। কথাবার্তা কম হল না। বেশ কিছুক্ষণ পর নুরু বেরিয়ে এল। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। কি কি কাজ করতে হবে না হবে তা ভালোভাবে সে বুঝে নিয়েছে।

কাজ বেশি নয়। নুরু আরেকবার কাজের তালিকাটা মনে করার চেষ্টা করে। প্রথম কাজ- সাহেবকে সাথে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া। পথ কি খুব বেশি? না, সাহেব বলেছিলেন মাইলদেড়েক হবে। তবে তো ভালো। এর চেয়ে কত বেশি পথ সে আগে হেঁটেছে। চাচার সঙ্গীত দলের সাথে কত যে হাঁটতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই তুলনায় এটা যৎসামান্য। কষ্ট বেশি হবে না। দ্বিতীয় কাজ- বাসা থেকে ভাত নিয়ে আসা। সেটাও কঠিন নয়। তৃতীয় কাজ- মাঝে মধ্যে সাহেবের জন্য রঙিন পানি কিনে আনা। ব্যস, এর চেয়ে বেশি নয়। করিম চাচার পড়া করিম চাচাই পড়ুকগে। ওসব আর নুরুর দরকার নেই। নাইবা দরকার হল, কিন্তু বাড়িতে তো খবরটা দেয়া দরকার। নইলে মা চিন্তায় শেষ হবে যাবে। বাসুদেবকে দিয়ে খবরটা পাঠালে মন্দ হয় না। ওকে স্টেশনেই পাওয়া যাবে। নুরু ছুট দিল সেদিকেই। জায়গামত বাসুদেবকে পেয়ে তাকে ঠিকঠাক বলে আসলো।

নুরুর দিন বেশ ভালোই কাটতে থাকে। এলাকাটা শহর না হলেও একেবারে গ্রাম নয়। মফস্বল বললে মানাবে ভালো। আগে তো পাড়াগাঁয়ের বাইরের হালচাল নুরু জন্য পুরোটাই অজ্ঞাত ছিল। এখানে এসে অল্প স্বল্পভাবে সেসব রপ্ত হচ্ছে। দিন পার হতেই থাকে। মাসও কেটে যায় কয়েকটা। নুরুর মন বাড়ির দিকে মোটেও টানে না। সাহেবও মানুষ হিসেবে খারাপ না।

প্রতিদিনের মত আজও যথা সময়ে সাহেবের ডাক পড়লো। নুরুর হাজির হতে বিলম্ব হল না। সাহেব কি বলবেন নুরুর জানা আছে। রুটিন মাফিক কোনো একটি কাজ। কিন্তু সাহেব রুটিনের কোনো কাজ না বলে সম্পূর্ণ নতুন কথা বললেন- "তুমি দিন কয়েকের জন্য কোথাও ঘুরে আসতে পারো?"
নুরু সাহেবের কথা তেমনটা বুঝলো না। তারপরও বললো- "পারি"।
- “তবে আজকেই যাও”। হাত লম্বা করে বেশ কিছু টাকা মেলে ধরে।
- “এত টাকা”।
- “তোমার দু'মাসের বেতন”।
- “আজকেই যাব?”

সাহেব মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলেন। নুরু ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। তারপর একেবারে রাস্তায়।
চাকরি খতম তার মানে তো বাড়ি ফিরে যাওয়া নয় বরং নতুন কিছুর সন্ধান করাটা বোধহয় ভালো হবে। সাহেবের বাড়ির কাজের সুবাদে অনেকেই তাকে চিনেছে। অনেক এলাকাও চেনার সুযোগ হয়েছে। চেষ্টা করে দেখলে হয়তো কোনো এক জায়গায় একটা কাজ মিলবে। ওপাশের বক্‌শ মিয়ার দোকানটা খদ্দেরপাতি ভালোই হয়। বুড়োটা একা কাজ করে। তাকে বললে কি এ দোকানের একটা কাজ দেবে? বলেও দেখা যাক। নুরু এগোতে থাকে বক্‌শ মিয়ার দোকানের দিকে। বুড়ার মন-মেজাজ ভালো। কথা বলে লাভ হতে পারে। নুরু তার পাশে গিয়ে বসলো। কথা শুরু হলো। ভূমিকাটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও পরে আসল কথাটা পেশ করার জন্য পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালালো।

কথাটা তাকে বলে লাভ হলো, তবে পুরোপুরি না। একটু সমস্যা থাকলেও নুরু কাজটা হাতছাড়া করলো না। বক্‌শ মিয়ার এক কথা- খাওয়া দেবে, মাইনে দেবে কিন্তু থাকার জায়গা দেবে না। আপাতত সেটাই ভালো। শুধু রাতটুকুর জন্য চিন্তা তো; সে কোনো একভাবে পার হয়ে যাবে। কথা শেষ তো কাজ শুরু। কাজ বলতে- ময়দা দিয়ে নান্তা তৈরি করা এবং তা পরিবেশ করা। তেমন কষ্টের কিছু নয় তবে সমস্যাটা হলো রাত কাটানো নিয়ে। ব্যবস্থা একটা হবে এ ভরসা তার আছে। ভরসাটা যে কিসের উপর ভিত্তি করে তা অবশ্য নুরুর জানা নেই। কাজের পাঠ চুকিয়ে দোকান থেকে বিদায় নেয় নুরু।

মাথার মধ্যে অন্যান্য চিন্তাগুলো কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। শুধু একটা চিন্তার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে। তা হলো ঘুমানোর জায়গার চিন্তা। কাছাকাছি তিনতলা একটা বাড়ি আছে। ওটার কথা মনে হতেই নুরুর মনটা ভাবুক হয়ে উঠলো। বাড়িটার সিঁড়ির নিচে থাকলেই বা কার কি ক্ষতি হচ্ছে? শুধুমাত্র রাতটুকুই তো। সঙ্গে যেহেতু পুটলি-পাটলি কিছু নেই তাহলে আর চিন্তা কেন? নিশ্চিন্তে দে ঘুম।

ভালোভাবেই রাতটা চলে যায়। সকালে কারো কোনো প্রকার জেরার মুখোমুখি না হয়েই নুরু দোকান পানে ছোটে। সন্ধ্যায় আবার আসে। সকালে চলে যায়। এভাবেই দিন পার হয়। কিন্তু এক সময় স্বাভাবিকতা নষ্ট হল। উপর তলার এক ভাড়াটে পুলিশের নজরে পড়ে নুরু। যেন তেন চোখ নয় একেবারে পুলিশী চোখ। সন্দেহপ্রবণ তো থাকবেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি তিনি নুরুকে পরখ করতে থাকেন। চেহারা সুরতে কোনো বখাটে ভাব নেই। একটু আধটু ভদ্রতার ছাপও পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত নুরুকে না জাগিয়ে তার কৌতুহল মিটলো না। তারপর শুরু হলো শোনা বোঝার পালা। একেবারে নাড়ী-নক্ষত্র শুনেই ছাড়লেন। শুনে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল তার। এইটুকু মানুষের এত কষ্ট কি সহ্য হয়? ছেলেটার লেখাপড়ার প্রতি টান আছে। সুযোগ করে দিলে পড়তে পারতো।
- "তুমি পড়বে খোকন?"
- "ইচ্ছে তো আছেই কিন্তু থাকলেই তা পূরণ হয়?"
ইন্সপেক্টর সাহেবের আন্দাজ ভারী হয়ে ওঠে। ক্রমশ দুর্বলতা তাকে গ্রাস করতে থাকে। ভাবেন, দেই না তাকে একটা সুযোগ করে। সাথে রেখে পড়ালেই ভালো হয় কিন্তু পুলিশের চাকুরি মানে তো ঘন ঘন জায়গা পাল্টানো। এতে ওর পড়ালেখা এগোবে না। তার চেয়ে গ্রামের বাড়ির স্কুলে দিলে কেমন হয়? একাধারে বেশ পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে।

ভাবনা মতই কাজ করলেন ইন্সপেক্টর সাহেব। নুরুকে নিয়ে এসেছেন তার গ্রামের বাড়ি। ভর্তি হলো নতুন শ্রেণীতে। এখানে পড়াশুনায় মন বসার কথা থাকলেও মন পড়াশুনার মধ্যে থাকে না। পাড়ার ঐ ছেলেরা খেলা করে বেড়াবে আর নুরু কিনা স্কুলের খাতা-পত্তর বয়ে বেড়াবে তাই কি হয়? সে জন্যই তো মাঝে মধ্যে বই থাকে বটগাছের কোঠরে আর নুরু থাকে মাঠে। ছুটির সময় বাড়ি গেলেই হলো। ওরা তো আর দেখতে আসছে না।

এভাবে চললে পড়াশুনা এগোবার কথা নয়। পড়াশুনা না এগোলেও পরীক্ষা তো আর দেরি করে আসতে পারে না। পরীক্ষা সময়মত শুরু হয়ে গেছে। বাংলা পরীক্ষা আজ। অন্যান্য বিষয়ে নুরু কাঁচা, তবে বাংলাতে বেশ ভালো। 'বঙ্গে শরৎ' রচনা লিখতে বলা হলো। নুরু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্যারকে বলে- "স্যার, আমি যদি 'বঙ্গে শরৎ' বিষয়ে এভাবে রচনা না লিখে কবিতা আকারে ভাব প্রকাশ করি তবে হবে? তৎক্ষণাৎ পটাশ করে শব্দ। নুরুর গালের বাম পাশটা বড্ড জ্বালা করছে। বুঝতে বাকী রইল না যে, এখানে স্যারর থাপ্পড়টা এসে পড়েছে।
- "বেয়াদব, আমার সাথে ইয়ার্কি!"

আর কোনো কথা নয়। চুপচাপ লেখা চললো। অপমানটা কম লাগেনি। মন ভার। স্যার কি ভালোভাবে বলতে পারতেন না? খাতা জমা দিয়ে সবার সাথে নুরুও বেরিয়ে পড়ে। পরের দিন সবাই আসে কিন্তু তাদের দলে নুরু নেই। ছেলেটার বড্ড জিদ। এরা না জানলেও মা জাহেদা ভালো জানে। খোঁজাখুজি শুরু হল। খুঁজলেই কি তাকে পাওয়া যাবে? ততক্ষণে নুরু মায়ের আঁচলতলে হাজির। ছেলেকে পেয়ে মা জাহেদা বেগম কম খুশি নয়, যদিও ছেলেটা আবারও কোনখানে যাবে কি না তার কোনো ঠিক নেই। লোকে বলে- মীন রাশির মানুষেরা নাকি একটু অস্থির প্রকৃতির হয়। ওর রাশিও তো মীন। সে জন্যই হয়তো এমন।

বাড়িতে এসেও নুরুর ভাবনা থেমে নেই। মনে মনে ভাবে- রাগ করে পড়াশুনাটা ছেড়ে দেওয়া বোধহয় ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। এখানের স্কুলেও তো পড়া যায়। নুরুর বাল্যবন্ধু শৈল তো পড়ছে। ও পারলে নুরু পারবে না কেন? শৈলের সাথে কথা বলতে হবে। দেরি করাটা ঠিক হবে না ভেবে নুরু শৈলের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে।

দেখা হলো না শৈলের সাথে। কি করা যায়? একটা চিঠি লিখে রেখে গেলে মন্দ হয় না। চিঠিটা ওর হাতে পড়লে ও ফিরাবে না, কোনো একটা ব্যবস্থা করবে। তাই করা হলো। কিছুদিন পরেই শৈলের সাথে দেখা। খবরটা এতো ভালো হবে নুরু তা আশা করেনি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে নাকি কথাবার্তা পুরোপুরি ঠিকঠাক করে ফেলেছে। সেই সাথে বোডিংয়ে থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে। সত্যিই বন্ধুটা অনেক কিছুই করেছে। সুযোগটা যখন হয়েই গেল তখন আর সময় ব্যয় করে লাভ নেই। যোগদান করাই ভালো হবে বলে মনে হলো নুরুর কাছে। যে ভাবা সেই কাজ। নুরু ভর্তি হল স্কুলে।

পড়াশুনায় আর অলসতা করা ঠিক হবে না ভেবে বইয়ের দিকে একটু মন দেয় নুরু। বইও যেন তার দিকে এগিয়ে আসলো। ফলে অন্যদের কাছ থেকে মেধাবী খেতাবটা পেতে খুব বেশি দেরি হল না।

নুরু অনেককে বলতে শুনেছে তাদের নাকি সময় কাটতে চায় না। আর নুরু তো সময়ই পায় না। তিন বন্ধু এক জায়গায় হলে সময় কোন ফাঁক দিয়ে চলে যায় তা বোঝাই যায় না। তিন বন্ধুর মধ্যে নুরু মুসলমান, শৈল হিন্দু আর শৈলেন খৃষ্টান। জাতিতে মিল না হলেও মনেতে অমিল নেই। ধর্ম নিয়ে মানুষ এত ঠেলাঠেলি করে কেন নুরুর বুঝে আসে না। ভালো মন থাকলে তাকে বন্ধু বানাতে ক্ষতি কী?

ইতোমধ্যে এখানে কয়েকটা বছর পার হয়ে গেছে, যার কারণে তাদের সাথে আন্তরিকতাও গাঢ় হয়ে গেছে। যেখানে যায়, যা করে তিনজন এক সাথেই করে। তবে গোসলের সময় একটু বিপত্তি ঘটে। ওরা দু'জন পুকুরে যায়। কিন্তু নুরু যে সাঁতার জানে না। বলতেও কেমন যেন লজ্জা লাগে। সে কুয়া থেকে পানি তুলে গোসল করে। ব্যাপারটা লজ্জার হলে কী হবে ছেলের ভাব কম নেই। মুখে বলে-
-"খান্দানী বংশের লোকেরা পুকুরে নেমে খালি গায়ে দাপাদাপি করে না। ভদ্র মানুষের গোসল বাড়িতেই হওয়া ভালো। কুয়ার পানি কী সুন্দর! মনটা শীতল হয়ে যায়"।
চালাকিটা শৈল ধরে ফেলে। বলে-
-"চল নুরু, তোকে সাঁতার শিখিয়ে দেই।"
দ্বিগুন লজ্জা! অত ভাব নেওয়াটা বোধহয় ঠিক হয়নি।
- "বুঝেছ বেশ করেছ, কাউকে যেন বলতে যেও না, প্রেষ্টিজ থাকবে না।"
দু'জন পুকুরে যায়। দু'এক দিনে সাঁতার শেখাও শেষ। তারপর সারাদিন দাপাদাপিতে "খান্দানী বংশ", "ভদ্র ছেলে" সেসব কথাগুলো কোথায় হারিয়ে গেল তার ঠিক নেই।

দুপুরের পর বিকেল টাইমে নুরুর আরেকটা কাজ থাকে। এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করা। এয়ারগানটা অবশ্য নিজের নয়, আরেকজন ছেলের। সহপাঠী হওয়ার সুবাদে একটু আধটু ব্যবহারের সুযোগ পায়। তাই সুযোগটা সদ্বব্যাহার না করে ছাড়ে না। তবে পাখি মেরে নয়, অন্যভাবে। পাখির উপর আলাদা একটা মায়ার কারণে সে পাখি মারে না। সেবার একটা চড়ুই ছানা বাসা থেকে পড়ে গেলে তার বাসাতে পৌছে না দেওয়া পর্যন্ত নুরুর মনে শান্তি আসেনি। আর সেই নুরু কিনা পাখি মারবে? এ কথা সে ভাবতেই পারে না। বাগানের পাশে সাদা সাদা মূর্তিগুলোই নুরুর শিকারের বস্তু। ওরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও ওদেরকে সহজে মারে না। খুব কৌশলেই শিকার করে। ওরা শত্রু না হলেও মনে মনে ওদের শত্রু ভেবে নিয়ে গুলি করে। বড় মূর্তি বড় লাট, ছোটটা ছোট লাট আর পেঁপে গাছগুলো দারোগা, পুলিশ এসব। নুরুর মতে এরা একেকটা দেশের শত্রু। দেশের শত্রু মারা পাখি মারার চেয়ে আনন্দের। তাই নুরুও বেশি বেশি আনন্দ করে। এসব কাজ দেখে অন্যরা হাসলেও তাতে নুরুর কোনো প্রকার ব্যাঘাত ঘটে না, অনেকে পাগল বলতেও দ্বিধা করে না। ছেলেটা তো একেবারে ছোট নয়, ক্লাস টেনে পড়ছে। আর ক'দিন পরেই তো ম্যট্রিক দেবে। ও কেন ওসব করতে যাবে? তবু নুরুর কাজ বন্ধ হয় না।

শিকারের জন্য মাঝে মাঝে স্টেশনের পাশ দিয়ে যাওয়া পড়ে। দূর পাল্লার ট্রেনগুলো ওখানেই মানুষ দেওয়া-নেওয়া করে। এ আর নতুন কী? কিন্তু আজ যে মানুষগুলো ট্রেন থেকে নামলো তারা সাধারণ মানুষ নয়; সেনাবাহিনী। সবার হাতে অস্ত্র। ওরা নাকি দেশের শত্রু মোকাবেলা করার জন্য ঐ অস্ত্র ব্যবহার করে। নুরুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আত্মমগ্ন থাকার পর শৈলেনকে বলে-
- "ওদের বয়স কত হবেরে শৈলেন?"
- "কত আর হবে, প্রায় তো আমাদেরই মত।
নুরুর মুখটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। তার এ বিষণ্নতা শৈলকে জিজ্ঞাসু করে তোলে। ব্যাপারটা জানার জন্য বলে-
-"কেন কি হয়েছে?"
নুরু বাকহীন। তারপর আত্মধিক্কারের সুরে অনুচ্চস্বরে নুরুর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- "কী লজ্জা! একই বয়সের আমরা, অথচ ওরা আসল শত্রু মারে আর আমি পেঁপে গাছ আর ইটের মূর্তি মেরে লাফাই। ছিঃ ছিঃ আর মোটেও এভাবে নয়। ওদের মত হতে হবে। শৈল, এখন থেকে আমি যদি ওদের মত হই?"
- "কী বলছিল পাগলের মত, সামনে তোর ম্যট্রিক পরীক্ষা!”
- "তাতে কী?”
- "তাতে কী মানে! তুই স্কুলের সেরা ছাত্র। সবাই আশা করছে তুই পরীক্ষা দিয়ে জল-পানি পাবি।"
হো হো করে হেসে ওঠে নুরু। কিছুটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলে-
- "আরে শৈল, আমি জল-পানি না পেলে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বিন্দুমাত্র বিপর্যস্ত হবে না।"
শৈলের মুখে বিষণ্নের ছায়া পড়ে। নুরু যদি সত্যি সত্যি চলে যায় তবে তো পড়াশুনা একেবারে শেষ। একটু অভিভাবকের সুরে বলে-
-"এসব পাগলামী ছাড় নুরু”। জেদি ছেলের মতই উত্তর আসে- “পাগলামীটা যদি আমাকে না ছাড়ে?"
শৈল আর কথা বাড়ায় না। কথায় নুরুর সাথে ও তেমন পেরে ওঠে না। তাই ওস্তাতগিরি ভাব নিয়ে লাভ হবে বলে মনে করে না। পরক্ষণে সে নুরুকে ঘরে ফেরার তাগিদ দেয়। শৈলের পূর্বের কথায় নুরু কান না পাতলেও ঘরের ফেরার আহবানে দ্বিমত করে না। বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় দু'জন।

একসাথে ফেরার পর কয়েকটা দিন গত হলেও এখনও পর্যন্ত সেটাই নুরুর সাথে শেষ দেখা শৈলেনের। আর একবারও দেখা হয়নি। দেখা না হওয়ার পেছনে শৈলেনের কোনো আগ্রহহীনতা ছিল না। নুরুর ছিল কি না তা শৈলেনের কাছে স্পস্ট নয়। আজ এদিকটায় আসার প্রধান উদ্দেশ্য নুরুর খোঁজ নেওয়া।
বোডিং রুমে নুরুকে না পেয়ে প্রথমবারের মত হতাশ হয় শৈলেন। বিছানা পত্তরের পরিবেশ যেন বলে দিচ্ছে সেখানে দু-তিন দিন যাবৎ কেউ রাত্রিযাপন করেনি। স্কুলের স্যারদের কাছে জিজ্ঞেস করেও লাভ হল না। আশপাশের কেউও কিছু বলতে পারলো না। শৈলেনের ভাবনার গভীরতা বেড়ে যায়। বাঁদরটা গেল কোথায়? বাড়ি গেল নাকি? না, বাড়ি ফেরার মত ছেলে সে নয় এ কথা শৈলেনর ভালো করেই জানা আছে। কিন্তু কোন না কোনখানে তো অবশ্যই আছে। আর সেটা জানেই বা কে? শৈল কি ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে? হয়তো পারবে। ও যদি কিছু না জানে তবে আর কারো জানার সম্ভাবনা নেই।

শৈলেন পা বাড়ায় শৈলের বাড়ির দিকে। কিছুদূর যেতে না যেতেই গতি মন্থর হয়। তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেদিনের কথাগুলো। চলা থামিয়ে দেয়। শৈলের কাছে যাওয়ার আর প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। নুরু কোথায় গেছে তা এখন পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। নুরু ঠিক ওদের সাথেই চলে গেছে। ও যা বলে তাই করে। শৈলেনের মনে আবারো ভেসে ওঠে নুরুর সেদিনের কথাটা- "কী লজ্জা! একই বয়সের আমরা, অথচ ওরা আসল শত্রু মারে আর কিনা পেঁপে গাছ আর ইটের মূর্তি মেরে লাফাই! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!"
------------------------------
জাতীয় কবি'র উজ্জ্বল কৈশোর চিত্রণ।
(২০০৪ সালে প্রকাশিত)