ওয়াদা

মার্কেটের সিঁড়িতে পা রেখেই পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগের অস্তিত্ব পরখ করে নিলামযদিও আমার পকেট থেকে আজ অবধি কোনো পকেটমার সুবিধে করতে পারিনি তারপরও কেনাকাটা জাতীয় ব্যাপারগুলোতে এসে অভ্যাস বশত পকেটটা একবার চেক করে নেইএই চেক করার অভ্যাসটা নিজের কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে অন্য জনের অভিজ্ঞতা থেকেএকটা নাটকে একবার দেখেছিলাম নায়ক ব্যাটা তার প্রেমিকা নিয়ে রেষ্টুরেন্টে খাওয়ার পর বিল দিতে গিয়ে দেখে মানিব্যাগ হাওয়াক্যাশিয়ার মহাজন তো মেয়েটির সামনে তাকে চিটার নামক খেতাবে ভুষিত করলেনঐ ব্যাটার কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি নিজের শিক্ষাটুকু গ্রহণ করলামকথায় বলে 'কেউ শেখে ঠেকে, কেউ শেখে দেখে'এ ক্ষেত্রে আমি 'দেখে শেখা'দের দলে পড়ে গেলাম

এই মার্কেটটাতে এর আগে আমার আগমন হয়েছে খুব কমসাগর বলেছিল নতুন এই মার্কেটের দোকানগুলো বেশ সুন্দর সুন্দর পোশাক তুলেছে, এবার ঈদে ওখান থেকেই কেনাকাটা করবোতাই ওর কথামতোই আজ আসাএকটা প্যান্টের দোকানে ঢোকার মুখেই আমার পকেট থেকে বিড়ালের ডাক শুনতে পেলামপকেট থেকেই ওটা বের করে হাতে নিতেই ওর মিউ মিউ ডাকটা দোকানের অন্য লোকদেরও কানে গেলতাদের চোখ আমার মিউ মিউ করে ডাকা মোবাইলটার দিকেগতকাল খেয়ালীর বশে বিড়ালের ডাক টোন বানিয়েছিলাম, কিন্তু পরে সেটা আর চেঞ্জ করতে মনে হয়নিডিসপ্লেতে তাকিয়েই আমার চোখ রীতিমত চড়ক গাছআমার আব্বার নম্বর যতবারই ডিসপ্লেতে ভেসে ওঠে ততবার আমার চক্ষু মহোদয় এই বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়আমি রিসিভ করে ভয়ে ভয়ে 'হ্যালো' বলতেই তিনি বললেন- তোর শাহানুর চাচার নম্বরটা তোর কাছে আছে?
- আছে
- এখনি এসএমএস করে পাঠা
মনে মনে স্বস্তিবোধ করলামতার সম্মুখে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেননি বলে মনে মনে শুকরিয়াও আদায় করলামশাহানুর চাচার নম্বরটি আমার ফোনে সেভ করা নেইনোটবুকে লেখা আছেছোট্ট নোটবুকটা প্যান্টের পকেটেই আছে

গত মাসে মোবাইলটা হারিয়েছিনতুন মোবাইল কেনার পর এই এক মাস ধরেও প্রয়োজনীয় নম্বরগুলো সেভ করে নিতে পারিনিযখন যেটা প্রয়োজন হয় সেটা বের করে কল করিমাস তিনেক আগে কী মনে করে যেন ভাতিজাকে মিষ্টি খাওয়ানোর বিনিময়ে ছোট্ট নোটবুকে নম্বরগুলো উঠিয়ে নিয়েছিলামসে কারণেই নম্বরগুলো রক্ষিত আছে, নইলে অসুবিধা হয়ে যেত

আমি পকেট থেকে নোটবুকটা বের করে সাগরকে বললাম- 'দেখতো, শাহানুর চাচার নামটা কোথায় আছেসাগর দুই তিনটা পাতা উল্টিয়ে বের করে দিলআমি ঝটপট নম্বরটা টাইপ করে এসএমএস পাঠিয়ে দিলামএই ফাঁকে সাগর নোটবুকের পাতাগুলো ওলট পালট করতে থাকেমেসেজটা সেন্ড হওয়ার পর আমি নোটবুকের দিকে তাকালামসবেমাত্র সাগর যে পাতাটা খুললো সেটা দেখেই আমি রীতিমত ঘাবড়ে গেলামপরিস্থিতির পাশ কাটানোর উদ্দেশ্যে ব্যস্ততা দেখানোর উপায় খুঁজতে লাগলামবছরখানেক আগে এক গরীব পরিবারের করুন জীবনযাপন দেখে সাগর ও আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এবার ঈদে নিজেরা কিছু না কিনে সেই টাকা দিয়ে এদের জন্য কিছু পোশাক কিনবোআর ওয়াদা স্বরূপ এই নোটবুকে সেদিন বেশ বড় করে ঐ প্রতিশ্রুতির কথাটা লিখে রেখেছিলামকিন্তু তা ঠিক রাখিনিসাগরের হয়তো মনে নেই আর আমিও মনে রাখার চেষ্টা করিনিঠিক করে আজকেই সেই ওয়াদার কথাটা সামনে পড়লোকেনাকাটার পরে এটা চোখে পড়লে না হয় আপসোস করে বলতাম- ইশ আগেই যদি এটা দেখতাম তাহলে আর নিজের জন্য না কিনে ওদের জন্য কিনতামকিন্তু একথা বলার আর সুযোগ হলো নাসাগর এখনো লেখাটা দেখেনি, ও দেখার আগেই নোটবুকটা নিয়ে নেয়া দরকার, নইলে আমার শার্ট-প্যান্ট কেনার ইচ্ছেই মাটি হয়ে যাবেওর হাত থেকে নোটবুকটা নিতে যাবো তখনই খেয়াল করলাম ও ঐ লেখাটা পড়ছেআমি চিন্তিতভাবে অন্যদিকে ফিরলামসাগর হুট করেই আমার মুখের দিকে তাকলোআমিও ফিরে তাকালাম তার দিকেসে দ্রুত নোটবুকের পাতাটা ঢেকে দিয়ে বললো- "চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে"তার ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে আমি নোটবুকের লেখাটা দেখিনি বলে সে বেশ স্বস্তিবোধ করছে

আমরা সামনে হাঁটতে থাকলামআমরা উভয়ই যার যার মত করে ভুলে যেতে চাচ্ছি যে, আমাদের কোনো ওয়াদা ছিলসাগর যেভাবে নোটবুকের পাতাটা ঢেকে দিল এভাবেই বোধহয় ওদের জীবনের চাওয়া-পাওয়াগুলো ঢাকা পড়ে যায় আমাদের মত মানুষদের হেয়ালীপনায়