ব্যাপারটা কুসংস্কার হতে পারতো

ওটাকে দেখেই হতভম্ব হয়ে যায় বিমল। মাথাটা কেমন যেন একটা চক্কর দিয়ে ওঠে। সে থ হয়ে বসে পড়ে বারান্দার টুলের উপর। আরেকবার চোখ তুলে তাকায় ওর দিকে। হ্যাঁ, সে ঠিকই দেখেছে; ভুল দেখেনি। তার চারপাশের সবকিছু এখন যেন ভার ভার লাগছে। সে নজর নামিয়ে আস্তে আস্তে মাথাটা নিচু করে চোখ দুটি বন্ধ করে।

বিমলের স্ত্রী মনিকা এদিকে এখন নেই, থাকলে হয়তো এখনই বিমলের হতভম্ব হয়ে বসে পড়ার কারণ জানতে চেয়ে মুখের পানে চেয়ে থাকতো। সে জানতে চাইলে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে হতো, নতুবা মিথ্যা বলতে হতো। মিথ্যা কথা বলাটা বিমল পছন্দ করে না, কিন্তু আজ বলতে হতো। কারণ, এ কথাটা মনিকাকে বলা ঠিক হবে না। বাইশ বছরের বিবাহিত জীবনে মনিকার সাথে সে খুব কমই মিথ্যা বলেছে।

ইদানিং বিমলের মন মানসিকতা খুববেশি ভালো যাচ্ছে না। সুমিত্রার বিয়ের ব্যাপারে বেশ প্রেশানি যাচ্ছে। মেয়েটা বিয়ে দিতে পারলে বিমলের মাথা থেকে বড় ধরনের একটা বোঝা নেমে যাবে। কিন্তু সেই বোঝাটা খুব সহজে নামবে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। গত বছর যাদবপুর থেকে এক পরিবার সুমিত্রাকে দেখে গিয়েও কোনো খবর পাঠায়নি। বিমল নিজে খোঁজ নিয়ে তাদের মতের কথা জানতে চাইলে তারা জানায় মেয়েকে তাদের পছন্দ হয়নি। অবশ্য অন্য মারফতে জানা গিয়েছিল তাদের পিছিয়ে যাওয়ার অন্য কারণ ছিল। এরপর অনেকদিন এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি বিমল। মাস দুয়েক আগে কেশবপুর থেকে ঘোষ পরিবারের লোকজন সুমিত্রাকে দেখে গিয়েছিল। পরে তারা জানালো তাদের মেয়ে পছন্দ হলেও পরিবার পছন্দ হয়নি। তারা পবিবার পছন্দ বলতে কি বুঝাতে চেয়েছে তা বিমলের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তার পরিবারের একটা দুর্বল দিক রয়েছে। সেটার সাথে সুমিত্রার কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও পৈত্রিক সূত্রে তার উপর চাপানো হয়েছে। বিমলের মাসতুত (খালাত) ভাই আগামী কাল আরেক পক্ষকে আনতে চেয়েছে। বিমলের দুর্বলতার কথাগুলো তাদের কানে গেলে তারা যে পিছিয়ে যাবে না তা হলফ করে বলা যায় না। পরিবারের এ সমস্যাটা নতুন সৃষ্ট নয়, এই একই সমস্যা বিমলের বিয়ের সময়েও ঘটেছিল।

বিমল বিয়ে করেছে বাইশ বছর হলো। বিয়ের আগে তাকে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল। পাত্রী পক্ষরা তার সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না। অনেকে তো মুখের উপর বলেই দিয়েছিল “পিতৃ পরিচয়হীন কোনো ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেব না”। কথাটা খুব খারাপ লেগেছিল বিমলের। ভেবেছিল আর নিজ এলাকায় বিয়ের কথা ভাববে না, দূরের গ্রামে যাবে মেয়ে দেখতে। কিন্তু সেটাও ঝামেলাহীন ছিল না। পাত্রী দেখে আসার পর পাত্রী পক্ষরা পাত্রের বাড়ি-ঘর দেখতে এসে যখন এলাকাবাসীর কাছে শোনে ছেলের বাবার কোনো সঠিক পরিচয় নেই, তখন তারা আর অগ্রসর হয় না। এমনিভাবে আরো তিন বার সম্বন্ধ ভেঙ্গেছে, তাতে কিছ্ইু করার ছিল না বিমলের। সমাজে সংখ্যালঘুরা সচরাচর যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়ে থাকে তার শতভাগই বিমলের ভাগ্যে জুটেছে। কারণ, বিমলদের পাড়ায় গোটাকয়েক হিন্দু পরিবার ছাড়া অধিকাংশ পরিবারই মুসলিম। তাছাড়া প্রভাব প্রতিপত্তিহীন মানুষদেরকে কেউ মূল্যায়নও করতে চায় না। সামান্য কিছুতেই তাদেরকে কটু কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না। সেদিক থেকেও বিমল এর আওতায় পড়ে। তাই তো পাড়ার মুদি দোকানের বাকির খাতায়ও বিমলের নামের পাশে ‘পাঞ্জাবীর বেটা’ নামক অপমানজনক শব্দটি সানন্দে শোভা পায়।

বিয়ের আলোচনার প্রেক্ষিতে মানুষের অবজ্ঞা আর অপমানের কথা শুনতে শুনতে একপর্যায়ে সে সিন্ধান্ত নিয়েছিল বিয়েই করবে না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে আর বহাল থাকা হলো না। তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারের কাজগুলো ঠিকমত করতে পারতো না। বিশেষ করে রান্না করার জন্য সংসারে একজন মেয়ে মানুষের খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই অপমান আর কটুক্তির কথা মাথায় নিয়েও পাত্রী খোঁজার চেষ্টা অব্যহত রাখতে হয়েছিল।

একটার পর একটা বিয়ের সম্বন্ধ নাকচ হয়ে যাওয়ায় বিমল এক সময় দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিতৃষ্ণা আসে জীবনের প্রতি। বিয়ের সূত্র ধরেই তার জীবনের কালো অধ্যায়টা নিয়ে মানুষ বেশি খোঁচাখুচি করার সুযোগ পেয়েছে। মাঝে মাঝে বিমল তার মানসিকশক্তির প্রান্ত সীমায় চলে যায়। উৎপীড়িতের মতই বিধাতার প্রতি ফরিয়াদ করে, বিধাতা কেন তার জন্মের ইতিহাসটা কালিমায় ভরে দিল? কেন সে মানুষের টিটকারীর পাত্র হয়ে জন্মেছে? বিমলের এ কথাগুলো হয়তো বিধাতার কাছে পৌঁছাতে দেয় না, শূন্যের মাঝে ভাসিয়ে রেখে সমাজের মানুষদের মত সেও উপহাস করে। 

বিমল ফুল গাছ লাগাতে ভালোবাসে। তার ঘরের সিড়ির কাছে সব সময় কোনো না কোনো ফুলের গাছ থাকেই। প্রথম যখন সে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখার কথা ভাবছিল সে সময়টাতে তার গাঁদা ফুলের গাছের পাতায় একটা কালো রঙের প্রজাপতি প্রায়ই দেখা যেত। দীর্ঘ সময় সেটা এপাশ ওপাশ ঘুর ঘুর করতো। এভাবে চলতে থাকে কয়েক দিন। একদিন বিমল কথা প্রসঙ্গে কালো প্রজাপতির কথাটা হরিপদ মন্ডলের কাছে গল্প করে। হরিপদ মন্ডল এলাকার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হিন্দু। বিমল তাকে দাদু বলে ডাকে। বিমলের কথা শুনে বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে- “লক্ষণ তো ভালো না রে দাদু। বিয়ের বয়সে কালো প্রজাপতি আশে পাশে ঘুর ঘুর করলে সুন্দর মেয়ে কপালে জোটে না”। কথাটা শুনে বিমল বেশ হেসেছিল। বুড়া-বুড়িদের এমন অনেক কথা সে শুনেছে যা ভদ্রসমাজের কাছে কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। তাই বিমলের বিশ্বাস ছিল বুড়ার এ কথাটাও নিঃসন্দেহে কুসংস্কারের তালিকায় যুক্ত হবে।

নানা চড়াইউৎরাই পেরিয়ে অবশেষে বিয়ে হয় বিমলের। বিয়ের এক মাস পর বিমলের মনে পড়ে যায় হরিপদ বুড়ার কথাগুলো। বুড়ার কথাগুলো মিথ্যে হয়নি। সুস্থ-সবল কোনো সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করা বিমলের ভাগ্যে জোটেনি। শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ে করতে হলো মনিকা নামের একজন শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত নারীকে। মনিকার পায়ে সমস্যা, বাম পা টেনে টেনে হাটে। মনিকা সুস্থ-স্বাভাবিক হলে হয়তো তার স্বামী হওয়ার যোগ্যতা ছিল না বিমলের।

বিভিন্ন সময়ে বিমল যখন মানুষের কটু কথা শুনে মন ভার করে থেকেছে তখন তার মা মিনতি রাণী ছেলের মনের অবস্থার কথা আচ করতে পেরে নীরবে চোখের পানি ফেলেছে। বিমল অনেকবারই তার মায়ের কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার কথা ভেবেছে। কিন্তু মায়ের মনে কষ্ট যাওয়ার আশঙ্কায় প্রতিবারই পিছিয়ে গেছে। তাই মায়ের কাছ থেকে কথাগুলো কখনো জানা হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত বিমল তার জন্মের কলুষিত অধ্যায়ের সেই কথাগুলো জানতে পেরেছে তার মায়ের সই (বান্ধরী) যমুনা রাণীর কাছে। একদিন বিমল কথায় কথায় তাকে ঘিরে সমাজের কটু কথাগুলো যমুনা মাসীর কাছে বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। বিমলের মানসিক অবস্থা দেখে যমুনা মাসী তাকে সান্ত¦না দিতে গিয়ে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। সে জানায় সমাজে প্রচারিত বিমলের জন্ম সংক্রান্ত কথাগুলো সত্যি, তবে এতে বিমলের মায়ের কোনো দোষ ছিল না। যমুনা মাসী সম্পূর্ণ ঘটনাটা সেদিন বিমলকে খুলে বলে।

যমুনা মাসী জানায় একাত্তর সালের প্রথম দিকে বিমলের মায়ের বিয়ে হয় অমলেষের সাথে। এর কয়েক মাস পরেই যুদ্ধের তোড়জোড় শুরু হয়। এরই মধ্যে একদিন অমলেষ তার এক আত্মীয়ের বাড়ি কী যেন এক কাজের জন্য গিয়ে আর ফিরে আসছিল না। পরে সেই আত্মীয়ের বাড়ি খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেখান থেকে অমলেষ অনেক আগেই চলে এসেছে। কিন্তু কোথায় গেছে তা আর জানা যায়নি। এর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। চারিদিকে ধ্বংস আর হানাহানি শুরু হয়। এলাকার কুদরত আলী হাত মিলায় পাক বাহিনীদের সাথে। অমলেষ বাড়ি না থাকায় সে মিনতিকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। কুদরত তাদেরকে বলে অমলেষ মুক্তিযুদ্ধে গেছে। অমলেষকে ওদের হাতে তুলে না দিলে তারা মিনতিকে আটকে রাখবে। এদিকে অমলেষের সাথেও তার পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই। পাকিস্তানীরা মিনতিকে ক্যাম্পে আটকে রাখে। দিন যায়, রাত যায়। সেখানে ক্যাম্পের ইনচার্জ থেকে শুরু করে সাধারণ সিপাহী পর্যন্ত সকলেই মিনতির উপর পাশবিক নির্যাতন চালাতে থাকে। অনেক বারই মিনতি পালিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। এদিকে অমলেষেরও কোন খোঁজ মেলেনি।

এক সময় যুদ্ধের দামামা শেষ হয়। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু অমলেষ আর ফিরে আসেনি। মিনতি ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেলেও শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের বাঁধনে আর জড়াতে পারেনি; তারা মেনে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত বাবার বাড়িতেই থাকতে হয়েছে তাকে।

যমুনা রাণী আরো জানায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার বাবা তাকে ভারতে তার কাকার বাড়িতে রেখে এসেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যমুনা দেশে এসে মিনতির অবস্থার কথা জেনে তাকে সান্ত¦না দিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। এভাবে চলতে থাকে দিন। এক সময় মিনতি তার গর্ভে সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করে। মিনতি তখন আরো চিন্তায় পড়ে যায়। বাচ্চা হলে সমাজে তার পরিচয় কি হবে এটা ভেবেই সে আত্মহত্যা করার সিন্ধান্ত নেয়। কিন্তু যমুনা তাকে বারংবার মানসিক শক্তি যোগানোর চেষ্টা চালিয়েছে এবং চোখে চোখে রেখেছে। এখনকার সময়ের মত সেসময় ভ্রুণ অপসারণের ব্যবস্থা না থাকায় সে ধরনের কিছু চিন্তা করার অবকাশ ছিল না।

কয়েক মাস পর জন্ম হয় বিমলের। বিমলের জন্মের পর সামাজিক সমস্যাগুলো যেন আরো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। লোকজন মিনতিকে ‘পাঞ্জাবীর বউ’ আর বিমলকে ‘পাঞ্জাবীর পোলা’ বলে আখ্যায়িত করে। মিনতি নীরবে চোখের পানি ফেলে। অতীতে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করলেও বিমলের জন্মের পর অবুঝ দুধের বাচ্চার অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে এসেছে। এভাবে দিন পার হতে থাকে। নানা রকম সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে বিমল। তারপরের কথাগুলো তো বিমল জানেই। যমুনা রাণীর কাছ থেকে এসব কথাগুলো শোনার পর বিমল তার মাকে আর অপরাধীর কাতারে সামিল করতে পারেনি। বরং মনে হয়েছে তার চেয়ে তার মায়ের যন্ত্রণা কী কম?

বিমল বিবাহপূর্ব সময়টাতে খারাপ সময় পার করলেও মনিকাকে বিয়ে করার পর তা আর ততটা প্রভাব ফেলেনি। মনিকার শারীরিক সমস্যা থাকলেও বিমল এটা তার নিয়তি ভেবে নিয়েছিল। বিয়ের পর ভালোভাবেই কেটে গেছে বাইশটা বছর। মেয়ে সুমিত্রা ও ছেলে সুভাসকে নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিন। বিমল তার ছোটবেলার বঞ্চনার কথা, বিয়ের সময়কার অপমানজনক কথা সবই ভুলে যাওয়ার, ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে। ভুলেও গিয়েছিল। কখনো মনে হয়নি পুরান কথাগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠবে। কিন্তু সেটাই হলো। সুমিত্রার বিয়ের কথা উঠতেই পুরান কথাগুলো সমাজে আবার নতুন করে জেগে উঠলো। পর পর দুই বার সম্বন্ধ ভেঙ্গে গেল। তাই এটা নিয়ে ক’দিন ধরেই বেশ চিন্তায় ছিল সে। কিন্তু এর চেয়েও বড় অশুনি সংকেত তার জন্য অপেক্ষা করতে পারে তা কল্পনাও করেনি বিমল। সে কিছুক্ষণ আগে ঘর থেকে বের হয়েই সামনের ফুল গাছটায় ঠিক সেই রকম একটা কালো প্রজাপতি দেখতে পায়; যে রকম একটা কালো প্রজাপতি সে তার বিয়ের আগে দেখেছিল। সে কারণে ওটাকে দেখেই হতভম্ব হয়ে যায় বিমল। তার মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে ওঠে। সে থ হয়ে বসে পড়ে বারান্দার টুলের উপর। 

বিমল কিছুটা মানসিক শক্তি সঞ্চার করে ধীরে ধীরে মাথাটা উচু করে চোখ খুলে ফুলগাছটার দিকে আবার তাকায়। না, কালো প্রজাপতিটি এখনো যায়নি, ওখানেই বসে পাখনা দুলাচ্ছে।

# # #