এক টুকরো প্রশান্তি

এক.
হাসির শব্দটা আবারও শোনা গেল। বেশ উচ্ছাসিত কণ্ঠস্বর। হাসির উৎপত্তিস্থলটা দেখার জন্য মিজান সাহেব মাথা উঁচু করে শব্দের উৎসের দিকে তাকান। কয়েকটা কিশোর ছেলে গোল হয়ে বসে আছে। খেলাধুলা করলে না হয় বোঝা যেত হার জিত নিয়ে আনন্দ করছে। কিন্তু না, তা তো নয়। গোল হয়ে ওরা কি দেখে এত হাসাহাসি করছে ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে হলো মিজান সাহেবের।
এই এলাকাটা খুববেশি পরিচিত নয় মিজান সাহেবের। এদিকে তেমন আসা পড়ে না। সাদেক আলীর খোঁজ নেয়ার জন্যই আজ এদিকটায় আসা। সাদেক তার মিলে কাজ করে। হঠাৎ তিন দিন যাবৎ কাজে আসে না দেখে খোঁজ খবর নিতে এসেছেন। তার বাড়িটা কিছু দূর সামনে। একটা দোকান দেখে চা খাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল থামিয়ে বসেছিলেন মাত্র। আর এরই মধ্যে ছেলেগুলোর হাসাহাসি তার নজরে পড়ে।
মিজান সাহেব হাসির কারণ অনুমান করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না, ব্যর্থ হলেন। শেষমেশ পাশের লোকটির কাছে জিজ্ঞেস করলেন- ‘‘ভাই, ছেলেগুলো কি নিয়ে এত হাসাহাসি করছে?’’ লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে ওদিকে একবার তাকিয়ে বললেন- ‘‘রশীদ মিয়ার পাগলা ছাওয়ালডারে নিয়ে তামাশা করতিছে।’’ মিজান সাহেব অবাক হন কথাটা শুনে। ব্যাপারটা ভালোভাবে জানার ইচ্ছে হলো তার। তিনি চায়ের কাপটা রেখে টাকা মিটিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। কাছে গেলে হয়তো ছেলেগুলো সরে পড়তে পারে। কি নিয়ে হাসাহাসি করছে তার আর দেখা হবে না। তাই দূরে দাঁড়িয়েই নজর রাখলেন। দেখতে পেলেন সাত-আট বছরের একটা ছেলেকে ঘিরেই তাঁদের উন্মাদনা। ছেলেটা কথা বলতে পারছে না। আশে পাশের ছেলেগুলো তাকে খোচাচ্ছে, আর সে নানা ভঙ্গির শব্দ করছে। এটাই ছেলেগুলোর হাসির খোরাক জোগাচ্ছে। মিজান সাহেব তাকিয়ে থাকলেন ঐ ছেলেটার দিকে। ছেলেগুলোর অন্যদিকে কোনো খেয়াল নাই, তারা হেসেই চলেছে।
দুই.
বারান্দায় বসে পান খাচ্ছে রশীদ মিয়া। তার মনটা প্রায়ই খারাপ থাকে ছেলেটার জন্য। মাসুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার বড় চিমত্মা হয়। ভেবে কূল-কিনারা পায় না।
হঠাৎ দরজার কাছে মোটর সাইকেলের শব্দ শোনা যায়। শব্দ শুনে মনে হয় দরজার সামনেই মোটর সাইকেলটা থেমেছে। রশীদ মিয়া একটু ভাবে, কে আসতে পারে? আত্মীয়দের মাঝে কেউ নয় তা নিশ্চিত। সে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। দরজাটা খুলে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে বেশ অবাক হয় সে। মিজান তালুকদার তার বাড়িতে কি মনে করে আসবে ভেবে পায় না। মিজান সাহেব হাত বাড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন ‘‘আমি মিজান তালুকদার, আপনি কি রশীদ সরদার?’’ রশীদ সানন্দে মিজান সাহেবের হাতে মুসাফা করে জানায় মিজান সাহেবের নাম বলার প্রয়োজন নেই, তিনি রশীদকে না চিনলেও রশীদ তাকে ঠিকই চেনে। একজন সমাজসেবক হিসেবে মিজান সাহেবকে সবাই চেনে। তিনি নিজ উদ্যোগে একটি বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা করেন কথা কে না জানে। রশীদ তাকে ভিতরে এসে বসতে বলে।
বারান্দায় পাতা চেয়ারের উপর বসতে বসতে মিজান সাহেব জানালেন তিনি রশীদের সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছেন। রশীদ অবাক হয় তার কথা শুনে। তার সাথে মিজান সাহেবের মত মানুষের কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে তা ভাবনায় আসে না।
মিজান সাহেব জানালেন তিনি মাসুদের ব্যাপারে কথা বলার জন্য এসেছেন। মাসুদের সম্পর্কে মোটামুটি কিছু কথা জেনেই তিনি এসেছেন। রশীদ মনোযোগ দিয়ে শুনছে তার কথাগুলো। তিনি আরো জানালেন খেলার মাঠে তিনি মাসুদের আচার ব্যাবহার দেখে বুঝেছিলেন তার পারিপার্শিক অবস্থার কথা। সে কারণেই আসা। তিনি মাসুদের মাকেও ডাকতে বললেন।
মাসুদের মা রাহেলা বেগম রান্না ঘরে বসেই তাদের কথা শুনছিল। রশীদ মিয়ার ডাকে কাছে এসে বসে। মিজান সাহেব আবার বলা শুরু করলেন- ‘‘আমি তোমাদের ছেলেটাকে দেখেছি। তাকে ঘিরে আশে পাশের লোকজনের মমত্মব্য এবং আচার ব্যবহারও দেখলাম। তোমরা নিশ্চয় ছেলেটাকে নিয়ে দুশ্চিমত্মায় থাকো।’’
মিজান সাহেবের কথা শুনে রশীদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। রাহেলা বেগম কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। মিজান সাহেব অভয় দিয়ে রাহেলাকে তার কথা বলার জন্য বলেন। রাহেলা স্বামীর দিকে একবার তাকায়, তারপর বলে- ‘‘হ্যাঁ, আসলে ছেলেটাকে নিয়ে আমরা দুজনই খুব চিমত্মা-ভাবনা করি, কিন্তু কিছু ভেবে পাইনে। এলাকার মানুষ তারে নিয়ে যখন ঠাট্টা-তামাশা করে তখন খুব খারাপ লাগে। ডাক্তার-কবিরাজ অনেক দেখালাম, কোনো লাভ হয়নি। এক কবিরাজ বলেছে বাচ্চার জন্মের সময় অশুভ গ্রহের আচর পড়লি সে বাচ্চা বোবা, বধির, পঙ্গু, পাগল এসব হয়। মাসুদের জন্মের সময় নাকি একরমই হয়েছে। কেউ কেউ বলে মানুষ আগে পাপ কাজ করলে জন্মামত্মরে এরকমও হয়।’’
মিজান সাহেব মন দিয়ে শুনছিলেন রাহেলার কথাগুলো। রাহেলা কথা বলছিল, এদিকে রশীদের অসহায় মুখখানা যেন বলে দিচ্ছিল সমত্মানকে ঘিরে তার ভাবনাটা অনিশ্চয়তার ঘোরে ডুবে যাচ্ছে। মিজান সাহেব বললেন- ‘‘এগুলো আসলে কোনো গ্রহের সাথে সম্পৃক্ত না। পৃথিবী থেকে যে গ্রহের অনেক অনেক দূরে, সে কি জন্যে তোমার ছেলেকে বিকারগ্রসত্ম বানাতে আসবে? আর আমাদের ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দেয় প্রত্যেকটা নবজাত শিশুই নিষ্পাপ। এটা তার কোনো কর্মফল নয়। আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। কাউকে প্রচুর ধন সম্পদ দিয়ে, কাউকে ধন সম্পদ না দিয়ে, কাউকে সমত্মান না দিয়ে আবার কাউকে অসুস্থ সমত্মানও দান করেন। মানুষ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করে সেটাই আসল বিষয়।’’
তিনি আরো জানালেন যে, মাসুদের এ সমস্যাটা অটিজম নামের একটি সমস্যা যা মসিত্মষ্কের গঠন নিয়ে কাজ করে। এর কারণে সঠিক সময়ে ব্রেনের বিকাশ যথাযথভাবে বিকশিত হয় না। ফলে এসব শিশুরা বয়স বাড়া স্বত্তেও পারিপার্শ্বিক সবকিছু আয়ত্ত করতে পারে না। তারা বুঝতে পারে না কীভাবে মানুষের সাথে মিশতে হয়। সামাজিক রীতিনীতিগুলোও তারা শিখতে পারে না। একজন সুস্থ শিশুর মসিত্মষ্ক তার বয়সের সাথে সাথে  বিকাশ হতে থাকে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুর মসিত্মষ্ক স্বাভাবিকভাবে বিকাশ হয় না ফলে তাদের আচার ব্যবহারেও পরিবর্তন আসে না। তারা একটা কিছু করতে শিখলে সেটাই বার বার করে, সমাজের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে এবং নির্দিষ্ট রুটিনের মধ্যেই পড়ে থাকে, একটু ব্যতিক্রম হলেই হইচই শব্দ করে। কোনো সুখের বা দুঃখের পরিবেশের সাথে তাদের মানসিক অনুভূতি প্রকাশ পায় না। আবার কিছু বুঝতে পারলেও তা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারে না।
মিজান সাহেবের কথাগুলো বিহবলের মতই শুনছিল রাহেলা ও রশীদ। মাসুদের আচারণের সাথে সবই মিলে যাচ্ছে। মিজান সাহেবের কথা ফাঁকে রাহেলা এটাও জানিয়ে দেয় যে, মাসুদ একবার তার বাবাকে দাও দিয়ে গাছ কাটতে দেখে পরে সে দাও’টা হাতে নিয়ে কাটার মত সামনে কিছু না পেয়ে তার বাবার পায়ে কোপ মারতে যাচ্ছিল। সেদিন রাহেলা দেখে না ফেললে বিপদ হয়ে যেত।
রাহেলার কথা শুনে মিজান সাহেব বললেন- ‘‘এটা কাজের বৈশিষ্ট্য ভালোভাবে বুঝতে না পারার একটা লক্ষণ। সাধারণ শিশুরা এগুলো সহজে বুঝতে পারলেও এরা পারে না। আর গ্রামের মানুষ পাগল বলতে যা বোঝায় এটা আসলে তা নয়। অটিজম কোনো মানসিক সমস্যা নয়। সমাজের মানুষ সাধারণত অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই সেটা মেনে নিতে পারে না। তারা কটু কথা বলবে, টিটকারী করে মমত্মব্য করবে এটাই স্বাভাবিক। সমাজের মানুষের কথায় মন খারাপ করবেন না, ধৈর্য ধারণ করবেন। অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। তবে এটা কোন ঔষধ সেবনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এদেরকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই সুস্থ ও স্বাভাবিক করা যেতে পারে। ঢাকায় অটিস্টিক শিশুদের জন্য আলাদা স্কুল থাকলেও ঢাকার বাইরে তেমন নেই। তাই পারিবারিক ও সামাজিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই চেষ্টা করতে হবে।’’
মিজান সাহেবের এ কথাটা শুনে রাহেলা ও রশীদ একে অপরের দিকে তাকায়। মিজান সাহেব তাদের এ চাহনী বিনিময়েই বুঝতে পেরেছন তারা ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝতে পারেনি। তিনি তাদেরকে বুঝানোর জন্য বললেন- ‘‘প্রশিক্ষণ মানে তাকে শিখানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন- ওকে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে এবং ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে হবে, সে যেভাবে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেভাবেই বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। তাকে যেটা শিখানোর চেষ্টা করা হবে সেটা আনন্দের সাথে করতে হবে। যদি সে কোনো কাজ ভালোভাবে করতে পারে তাহলে তাকে প্রশংসা করতে হবে, পুরস্কারও দেয়া যেতে পারে। তাতে করে উৎসাহ বাড়বে। কোনো কাজ না পারলে রাগারাগি বা মারধর করা যাবে না, তিরস্কারও করা যাবে না। তার সাথে সমবয়সী শিশুর মত মিশতে হবে। সামাজিকতা বৃদ্ধির জন্য তাকে নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশি বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে হবে, তাদেরকেও বেড়াতে আসতে বলতে হবে। সবসময় ভালো ও শিক্ষামূলক কাজের মধ্যে ব্যসত্ম রাখতে হবে। তার অবসরেরও ব্যবস্থা করতে হবে। আশা করা যায় এসবে তার মানসিক উন্নতি হবে। সে কিছুটা বুঝতে পারার মত হলে তখন স্কুলে দিতে হবে।’’
রাহেলা ও রশীদ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মিজান সাহেবের কথাগুলো। মিজান সাহেব জানতে চাইলেন মাসুদ এখন কোথায়? রাহেলা বলে- ‘‘ঘরের মধ্যে আছে, নিয়ে আসছি।’’ মিজান সাহেব তাকে বাঁধা দিয়ে বলেন- ‘‘থাক, আনা লাগবে না। আমি আজ একটু ব্যসত্ম আছি। মাঝে মধ্যে এসে দেখে যাব।’’ কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালেন। সাথে সাথে রশীদ ও রাহেলাও উঠে দাঁড়ায়।
মিজান সাহেব বাড়ির দরজার দিকে আসতে থাকে, সাথে রশীদও এগিয়ে দিতে আসে।
তিন.
রাহেলা বেগম আগেও খেয়াল করেছে পাড়ার ছেলেরা মাসুদকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে। ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারে না। হোক না ছেলেটার আচরণ স্বাভাবিক নয়, তবু নিজের সমত্মান অন্যের কাছে হাসির পাত্র হবে তা মা হয়ে সহ্য করে কী করে? তাছাড়া মিজান সাহেবও বলেছেন মাসুদকে কোনভাবে তিরস্কার ভৎর্সনা করা যাবে না। তাই ইচ্ছে থাকলেও মাসুদকে খেলার মাঠে পাঠাতে ইতসত্মত বোধ করে সে।
খেলার মাঠটার দিকে তাকালে রাহেলার মনটা কেমন যেন করে। ইচ্ছে হয় অন্য ছেলেদের মত মাসুদও যদি খেলতে পারতো। তার সেই আশাটা আদৌ পূরণ হবে হবে কি না তা বোঝা যায় না।
উঠানে কাপড় তুলতে তুলতে রাহেলা দেখতে পায় পাড়ার ছেলেগুলো বাড়ির মধ্যে ঢুকছে। সচরাচর ওরা বাড়ির মধ্যে আসে না। রাহেলা এগিয়ে আসে তাদের দিকে। ছেলেগুলো কাছে এসে বলে- ‘‘চাচী মাসুদকে ডাইকে দেও, আমরা খেলতি যাই।’’  রাহেলা বেগম চুপ করে থাকে। ঘরের দিকে একবার তাকায়। মাসুদকে ডাকতে গিয়েও আবার থেমে যায়। তারপর ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে- ‘‘তোমরা তো ওকে নিয়ে হাসাহাসি কর, আমার খারাপ লাগে।’’  ছেলেগুলো আনন্দের সাথে রাহেলা বেগমের এই আশঙ্কাকে দূর করে দিয়ে জানায় যে, তারা আর কখনো মাসুদের সাথে এমন করবে না। তারা আরো জানায় এখন থেকে তারা মাসুদের সাথে ভালোভাবে মিশবে, তাকে বিভিন্ন জিনিস শেখাতে চেষ্টা করবে। একটা লোক তাদেরকে বলেছে মাসুদ তাদের মত সুস্থ নয়, তাই তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা না করে তার সাথে ভালো আচারণ করা উচিত। ঐ লোকটা তাদের একটা নতুন ফুটবল কিনে দিয়েছে, আর বলেছে মাসুদের সাথে তারা যদি মিলেমিশে খেলাধুলা করে তাহলে তিনি তাদের খেলাধুলার যাবতীয় জিনিস- ক্রিকেট বল, ব্যাট, স্ট্যাম্প সব তিনি কিনে দেবে।
রাহেলা বেগম ছেলেগুলোর কথা শুনতে শুনতে যেন অন্য কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিলো। ঐ মানুষটা নিশ্চয় তালুকদার সাহেবই হবে। তিনি বলেছিলেন মাসুদের বেড়ে ওঠার জন্য, সামাজিকতা শেখার জন্য ভালো পরিবেশ দরকার। রাহেলা মনে মনে তালুকদার সাহেবের জন্য শুভকামনা করে। রাহেলাকে অন্যমনষ্ক দেখে ছেলেদের একজন বলে- ‘‘সত্যি চাচী আমরা আর মাসুদের সাথে এমন করবো না, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। তুমি ওকে ডেকে দাও।’’ রাহেলা সঙ্গে সঙ্গে সেই ছেলেটাকে কাছে টেনে নেয়। তার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর ঘরের দিকে ছুটে যায় মাসুদকে আনতে।
মাসুদ ঘরের মধ্যে বসে পা দুলাচ্ছিল। রাহেলা মাসুদের হাত ধরে উঠিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে উঠানে নেমে এসে ছেলেগুলোর দিকে ইশারা করে মাসুদকে বলে- ‘‘যাও বাবা, ওদের সাথে খেলা করতে যাও।’’ ছেলেরা এগিয়ে এসে মাসুদকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে থাকে। ধীরে ধীরে তারা বাড়ির বাইরে চলে যায়। রাহেলা বেগম ছেলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চার.
জমি থেকে ফিরে ক্লামত্ম শরীর নিয়ে বারান্দায় এসে বসে রশীদ। বারান্দায় পশ্চিম পার্শ্বে মাদুরে বসে মুড়ি খাচ্ছে মাসুদ। রশীদ মাসুদের দিকে তাকায়। আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে মাসুদের। মিজান সাহেব মাঝে মধ্যে এসে খোঁজ খবর নেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের বুঝিয়ে বলার পর থেকে তারাও মাসুদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। এ কারণেই কয়েক মাসের মধ্যে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগে অযথা শব্দ করতো, হাত-পা নাড়া করতো। এখন এসব অনেকটা কমে গেছে।
রশীদের হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার জালের কথা। জালটা ছিড়ে যাওয়া ক’দিন যাবত আর মাছ ধরা হচ্ছে না। সে উঠে ঘরের মধ্যে যায়। জালটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসে। তারপর বারান্দায় বিছিয়ে কাজে মন দেয়। মাসুদ মুড়ি খেতে খেতে বাবার কাজের দিকে তাকায়।
রাহেলা বেগম স্বামীকে জাল মেরামত করতে দেখে বলে- ‘‘এই অসময়ে আবার ওটা নিয়ে বসলে কেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে। গোসল করে খেয়ে নাও।’’
রশীদ মিয়া জালের দিকে নজর করেই জানায় যে, আজ-কাল করে কাজটা আর করাই হচ্ছে না। এখন না করলে আর করা হবে না। গোসল একটু পরে করলেও অসুবিধা নেই। স্বামীর জবাব শুনে রাহেলা আবার নিজের কাজে মনোযোগী হয়।
হঠাৎ মাসুদ একটি শব্দ করে। শব্দটা রশীদের কানে গেলেও সে মাসুদের দিকে ফিরে তাকায় না। সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার শব্দ করে। রশীদ এবারও কাজে মনোযোগী। মাসুদ প্রায়ই এমন শব্দ করে তাই কাজ ফেলে তাকিয়ে দেখার বিশেষ কোনো কারণ দেখে না। এবার আরো জোরে শব্দ করে মাসুদ। রশীদ এবার চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। মাসুদ গলা উঁচু করে বাবাকে উপরের দিকে তাকানোর ইঙ্গিত করে। রশীদ উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। তাকের এক প্রামেত্ম দাও ঝুলমত্ম অবস্থায় আছে। যে কোনো সময় নিচে পড়ে যেতে পারে। ঠিক তার নিচেই রশীদ বসে কাজ করছে। তাকের উপর সে ভালোভাবেই দাও’টা রেখেছিল, হয়তো বিড়াল-টিড়াল যাওয়ার সময় পা লেগে কিনারায় সরে এসেছে। রশীদ অবাক হয়ে তাকায় মাসুদের দিকে। মাসুদের এমন ইঙ্গিতে রশীদ বুঝতে পারে যে, মাসুদ বুঝতে শিখেছে দাওটা উপর থেকে পড়লে তার বাবার ক্ষতি হবে। রশীদ আনন্দে চিৎকার করে গিয়ে মাসুদকে জড়িয়ে ধরে। রশীদের চিৎকার শুনে রাহেলাও কাজ ফেলে ছুটে আসে।
রশীদ মাসুদের গায়ে, মাথায় হাত বুলাতে থাকে। রাহেলা কি হয়েছে জানতে চেয়ে রশীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু রশীদ কোনো কথা বলে না। রাহেলা রশীদের মুখের পানে তাকিয়ে দেখতে পায় তার চোখে মুখে যেন একটা প্রাপ্তি, একটা প্রশামিত্মর আভা ফুটে উঠেছে।